বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

সন্তোষ মিত্র, অগ্নি যুগের এক বিপ্লবীর উপাখ্যান

August 15, 2024 | 3 min read

সৌভিক রাজ

এখন কলকাতার পুজো​ মানেই সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। লোকমুখে অবশ্য লেবুতলা পার্ক নামটিও বেশ জনপ্রিয়​। মধ্য কলকাতার এই বিখ্যাত সর্বজনীন দুর্গোৎসবে যার নাম জড়িয়ে সেই সন্তোষ মিত্র আদপে কে?​

ইংরেজদের গণহত্যায় মৃতদের মরদেহ আনতে হিজলী এসেছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। বন্দিদের উপর গুলি চালানো এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা​। এই হত্যাকাণ্ডের পরেই কলকাতা কর্পোরেশন তরফে সেন্ট জেমস স্কোয়ার-এর নাম বদলে নাম রাখা হয় ‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার’। তখন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, তিনিই ছিলেন এই নামবদলের প্রধান কান্ডারি​​।

আজকের এই পার্ক সংলগ্ন ১সি হলধর বর্ধন লেনের বাড়িতে জন্ম হয়েছিল সন্তোষ মিত্রের (Santosh Mitra)। সেখানে এক স্মারক বানানো হয়েছে তাঁর স্মৃতিতে​। কলকাতা কর্পোরেশন ‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার’এর ভিতরে তাঁর একটি মর্মর মূর্তিও স্থাপন করেছেন।

উত্তর কলকাতার এই সন্তোষ মিত্র ছিলেন ​​নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী। ১৯০০ সালের ১৫ই আগস্ট কলকাতায়, এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তোষ মিত্র জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯১৫ সালে কলকাতায় হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (প্রেসিডেন্সি কলেজ) থেকে দর্শন শাস্ত্রে​ সাম্মানিক স্নাতক হয়েছিলেন​। সন্তোষ মিত্র ছিলেন মেধাবী ছাত্র, এরপরে​ ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে ​উত্তীর্ণ হন। তিনি এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।/ভারতে তখন গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। অত্যাচারী ইংরেজকে দেশছাড়া করতে বাংলার প্রত্যেক যুবক তখন প্রায় বদ্ধপরিকর। সেই সংকল্পে সামিল হয়েছিলেন যুবক সন্তোষ কুমার মিত্র।

উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে সরিয়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ স্বাধীন করতে। কলেজ পাশ করার পর দুইয়ের দশকে ​বিপ্লবী সন্তোষ কুমার​ মিত্র অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি হুগলি বিদ্যামন্দিরে বিপ্লবী কাজের জন্যে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। হুগলি বিদ্যামন্দিরের প্রধান ছিলেন,​ বিপ্লবী ভূপতি মজুমদার। তাঁর মাধ্যমেই সন্তোষ মিত্রের সঙ্গে বিপ্লবী বারীন্দ্র ঘোষ এবং যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের পরিচয় হয়। ১৯২২ সালে গড়ে তোলেন স্বরাজ সেবক সঙ্ঘ। গান্ধীজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি তিনি এক সময়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রভাবিত হন সশস্ত্র​ বিপ্লব মতাদর্শে। শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের সময় অস্ত্র সাহায্য করতেন গোপনে​​​​। অহিংস আন্দোলনের সময় কারাবাসও করেছিলেন, ফলে চট করে ব্রিটিশদের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন।
​​ ​
১৯২৩ সালে ‘শাঁখারীটোলা হত্যা মামলায়’; এক ইংরেজ পোস্ট মাস্টারকে খুনের অভিযোগে,​ সন্দেহের বশে তাঁকে​​ গ্রেফতার করা। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান সন্তোষ মিত্র। বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলাতেও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এবারেও প্রমাণ ছিল না, ছাড়া পেয়েগিয়েছিলেন যান। সন্তোষ কুমার মিত্র ক্রমেই,​​​ ইংরেজদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইংরেজ সরকার ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ প্রয়োগ করে,​ দেশের নিরাপত্তার জন্যে তাঁকে বিপদজনক ​ঘোষণা করে। এই আইন অনুযায়ী,​ বিনা বিচারে যেকোনো মানুষকে আটকে রাখা যায়। ফলে সন্তোষ মিত্র ​হয়ে গিয়েছিলেন,​ ‘সিকিউরিটি প্রিজনার’।

তখন প্রচুর সংখ্যক মানুষকে বিনা অভিযোগে গ্রেপ্তার করে রাখা হতো, ফলে ​শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গ্রেফতার করে জেলবন্দি করে রাখার কারণে,​ শাসকের সামনে এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রথমত,​ পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। আলিপুর ও অন্য কারাবাসগুলোতে সাধারণত দাগি আসামিদের সঙ্গেই এঁদের রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, এই বন্দিদের যেহেতু কোনও পূর্ব অপরাধের অভিযোগ ছিল না; তাই​ সমাজে ও জনমানসে এই বিষয় নিয়ে​ ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ‘সিকিউরিটি প্রিজনার’ রাখার জন্যে ১৯৩১ সালে ইংরেজ সরকার আলাদা তিনটি​ ডিটেনশন ক্যাম্প,​ তৈরি করে। বহরমপুর, বক্সাদুয়ার এবং খড়গপুর রেল জংশনের কাছে হিজলীতে তৈরি হয়েছিল তিনটি ক্যাম্প।

হিজলীতে সন্তোষ মিত্রকে রাখা হয়েছিল। এই বিশেষ বন্দিদের কিছু স্বাধীনতা থাকলেও, যদিও​ বাইরের রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের কোনো অধিকার ছিল না। ওই বছর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চরমে পৌঁছায়,​ ​বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে​ ফাঁসি দেওয়া হয়। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির সাজা ঘোষণাকারী বিচারক রেনোল্ড গার্লিককেও ২৭শে জুলাই আলিপুরে কোর্টের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার খবর বেশ কিছুদিন পর হিজলী ক্যাম্পে পৌঁছয়। বন্দিদের মধ্যে উৎসব ও জয়ের উন্মাদনা দেখা ​যায়। ফলে শাসকদের সমস্ত রাগ গিয়ে পরে হিজলীর বন্দিদের উপর। ১৫ই সেপ্টেম্বর হিজলী জেল থেকে তিন বিপ্লবী বন্দি সফল ভাবে পালাতে সক্ষম হন।

ফলত পরিস্থিতি সামলাতে ১৬ই সেপ্টেম্বর বিশাল পুলিশ বাহিনী দিয়ে হিজলী ক্যাম্প ঘিরে ফেলা হয়। চলে তল্লাশি। কিন্তু কেবল তল্লাশিতে থেমে থাকেনি ইংরেজরা। এক বর্বরোচিত নরকীয় ​হত্যাকাণ্ড ঘটায় তারা। বিনা আদেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। মোট ২৯ রাউন্ড গুলি চলে। ২৫ জন বন্দি গুরুতর আহত হন। মারা যান তিনজন বন্দি। মৃতদের তালিকায় ছিলেন বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র। শহিদ হন সন্তোষ মিত্র। ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি ছুঁটে গিয়েছিলেন হিজলিতে​​। আজও পুজোর আড়ম্বরের আড়ালেই থেকে যায় লেবুতলা পার্কের​ তাঁর শহিদবেদি। আমরা সবাই সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারকে চিনি, কিন্তু সন্তোষ মিত্রকে কজনই বা চিনি!

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Independence Day, #Santosh Mitra

আরো দেখুন