কিভাবে অরবিন্দ ঘোষ বিপ্লবী থেকে সাধক হলেন?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কলকাতায় জন্ম হলেও বিদেশে পড়াশোনা করে হয়েছিলেন ইংলিশ ম্যান। একদিন তিনিই হয়ে গেলেন ইংরেজদের নাকানিচোপানি খাওয়ানো বিপ্লবী। আলিপুর বোমা মামলার মূল চক্রী। একদিন সেই বিল্পবীই আবার হয়ে গেলেন ধার্মিক ঋষি। তিনি ঋষি অরবিন্দ। তাঁর এই ঋষি হয়ে ওঠার পথ বেশ চমকপ্রদ।
১৮৮৪ সালেই তিনি লন্ডন যাত্রা করেন। আইসিএস এর লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন ২৫০ প্রতিযোগীর মাঝে ১১তম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু অশ্বচালনা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করায় আইসিএস সম্পূর্ণ হয় না। বিলেতে থাকা অবস্থাতেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের কথা জানতে পারেন ৷ সেখানেই তিনি তাঁর ভাইদের সঙ্গে এবং কিছু উৎসাহী ভারতীয় তরুণদের সাথে ‘লোটাস অ্যান্ড ড্যাগার’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। ফরাসী বিপ্লব ও আইরিশদের মুক্তি সংগ্রাম খুব সম্ভবত তাঁকে এইরকম একটি সমিতি গড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়েছিল৷
লন্ডনেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বরোদার মহারাজা সোয়াজীরাও গায়কোয়াডের, যিনি ২০০ টাকা মাসিক বেতনে তাঁর স্টেট সার্ভিসে অরবিন্দকে চাকরি দেন৷ ১৯০০ সালে অরবিন্দ ঘোষ বরোদা কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হন৷ ১৯০৪ সালে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৯৩ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বরোদায় কাজ করেন।
এখানেই তিনি ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও শাস্ত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। সংস্কৃত শিখে অধ্যয়ন করেন বেদ, উপনিষদ, গীতা, কালিদাস, ভবভূতি, রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি ইত্যাদি। বাংলার পাশাপাশি শেখেন গুজরাতি ও মারাঠি। ১৯০১ সালে বরোদায় থাকাকালীন তাঁর বিয়ে হয় ভূপালচন্দ্র বসুর কন্যা মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে।
বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের নিয়ে গড়ে ওঠে স্বদেশী আন্দোলনের মূল সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’। ১৯০৬ সালে শুরু হয় ‘যুগান্তর’ সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা ব্রিটিশ বিরোধী পত্রিকা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাংলায় প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়৷ অরবিন্দ বরোদার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলায় চলে আসেন এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কলেজের, বর্তমানে যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম অধ্যক্ষ হন ৷ একই সঙ্গে বিপিনচন্দ্র পালের ‘বন্দেমাতরম্’ ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের জন্য বিপিনচন্দ্র পাল এবং তিনি রাজদ্রোহে অভিযুক্ত হন৷ বিপিনচন্দ্রের ছয় মাস কারাবাসের সাজা হয়৷ প্রমাণের ভাবে অরবিন্দ মুক্তি পান৷ পাঁচ বছর (১৯০৬-১৯১০) সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন৷ বিপ্লবী দলের নেপথ্য নায়ক ও কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।
বারীন ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার মানিকতলায় তরুণ স্বদেশীদের বোমা তৈরী করার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল ৷ ইংরেজ বিচারক কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার দায়িত্ব পেয়েছেন ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকি৷ এই কিংসফোর্ড ছিলেন ভারতবিদ্বেষী৷ সামান্যতম অপরাধে বিপ্লবীদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতেন৷ কিন্তু এই হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয় বোমার আঘাতে দুজন ইংরেজ মহিলা মারা যান ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন ৷ প্রফুল্ল চাকী ধরা না দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে মৃত্যূবরণ করেন । ১৯০৮ সালের ১১-ই আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় ৷
এই মামলার সূত্র ধরে ১৯০৮ সালে ধরা পড়েন বারীন ঘোষ৷ কারণ তাঁদের ছোঁড়া বোমা মানিকতলার ওই বোমার মাঠেই তৈরি হয়েছিল বলে পুলিশ মনে করে। ৫ই মে ধরা পড়েন অরবিন্দ ঘোষ। বিপ্লব ও হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়। ধরা পড়েন উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো ল এই মামলায় এঁদের হয়ে লড়েছিলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও কবি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ৷ এই মামলা চলাকালীন স্বীকারোক্তিতে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ সম্পূর্ণ দায় নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন। সেই মামলায় অরবিন্দ ঘোষ বেকসুর খালাস পান। মামলা চলাকালীন কিছুদিন অরবিন্দকে আলিপুর জেলে থাকতে হয় ৷
জেলে থাকা কালীন তাঁর জীবনে পরিবর্তন শুরু হয়। আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি৷ অরবিন্দ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “জেলে থাকার সময় আমি অবিরাম শুনতে পেতাম স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। যখন আমি এক পক্ষকাল ধ্যানমগ্ন ছিলাম একা একটি কুঠুরিতে, বিবেকানন্দ যেন রোজ আমার সঙ্গে কথা বলতেন।”
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অরবিন্দ নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন আধ্যাত্মিকতায়। তখন আর রাজনীতিতে মন নেই৷ আধ্যাত্মিক সাধনার দিকে মন ঢলে গিয়েছে৷ ১৯১০ সালে রাজনীতি ত্যাগ করে পন্ডিচেরী গমন করেন৷ সনাতন ধর্ম প্রচার ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে বিপ্লবী অরবিন্দ ‘ঋষি অরবিন্দে’ পরিণত হন।