রাজনৈতিক স্বার্থেই নেতাজির ‘অন্তর্ধান’ আজও রহস্য!
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: গুগলে সুভাষচন্দ্র বসু টাইপ করলেই নেতাজি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য ভেসে উঠছে চোখের সামনে। তথ্য বলছে, ২৩শে জানুয়ারি, ১৮৯৭ সালে কটকে জন্ম হয় সুভাষচন্দ্র বসুর। আর ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট, অর্থাৎ আজকের দিনে তাইওয়ানের তাইপেইতে মৃত্যু হয় তাঁর। কোন তথ্যের ভিত্তিতে এবং কাদের আড়াল করতে গুগলে নেতাজির মৃত্যুর তারিখ ও কারণ এত নিশ্চিত ভাবে জানিয়ে দেওয়া হল?
ঐতিহাসিক লিওনার্ড এ গর্ডনের লিখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে নেতাজির মৃত্যুর বিষয়ে সেখানে লেখা হয়েছে, তাইপেইর তাইহোকু বিমানবন্দরে দুপুর ২টো ৩০ মিনিট নাগাদ একটি বিমান দুর্ঘটনায় শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল নেতাজির। ‘থার্ড ডিগ্রি বার্ন ইঞ্জুরি’ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানেই স্থানীয় সময় রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে মৃত্যু হয় তাঁর।
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি শাহনওয়াজ কমিশন এবং খোসলা কমিশনের রিপোর্টকেই মান্যতা দিয়ে মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, ১৯৪৫ সালে তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছে। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই ঘোষণার বিরোধীতা করে প্রশ্ন তোলেন নেতাজির পরিবারের সদস্যদের একাংশ, ফরওয়ার্ড ব্লকের জাতীয় সম্পাদক জি দেবরাজন-সহ অনেকেই।
বসু পরিবারের একাংশের মতে, এখনও এমন কোনও নথি সামনে আসেনি যা থেকে এটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব যে, ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ সালে তাইহোকু বিমানবন্দরে হওয়া বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছিল নেতাজির। সম্প্রতি নেতাজি সম্পর্কিত মোট পাঁচটি ফাইলের কথা জানিয়েছিল জাপান সরকার, যার মধ্যে মাত্র দুটি ফাইলই প্রকাশ করেছে তারা। যে দুটি ফাইল জাপান সরকার সামনে এনেছে তাতে নেতাজির অন্তর্ধান বা মৃত্যু সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্যই মেলেনি। তবে বাকি তিনটি ফাইল কিন্তু এখনও সামনে আসেনি। পরিবারের দাবি, এই তিনটি ফাইলে ঠিক কি আছে, কেন এই তিনটি ফাইল প্রকাশ করতে চাইছে না জাপান সরকার, সে সম্পর্কে জানতে উদ্যোগ নিক কেন্দ্র।
অন্তর্ধান না মৃত্যু, নেতাজি রহস্যের অনুসন্ধানের জন্য ভারত সরকার এ পর্যন্ত তিনটি কমিশন গঠন করেছে। ১৯৫৬ সালে শাহনওয়াজ কমিশন, ১৯৭০-এ খোসলা কমিশন এবং ১৯৯৯-তে মুখার্জী কমিশন। এর মধ্যে শাহনওয়াজ এবং খোসলা কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৯৪৫-এর ১৮ই আগস্টে জাপানের তাইপেই-র তাইহোকু বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছে।
পরবর্তীকালে মুখার্জী কমিশন আগের দুই কমিশনের তত্ত্ব খারিজ করে দেয়। এই রহস্য সমাধানে সর্বশেষ গঠিত মুখার্জি কমিশনের বিচারপতি মনোজ মুখার্জির রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮ই আগস্ট, ১৯৪৫ সালের বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। এ বিষয়ে তাইওয়ান সরকারের পাঠানো একটি চিঠিতেও মুখার্জি কমিশনকে জানানো হয়েছিল যে, ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্টে তো নয়ই, তার আগে বা পরের ৭ দিনেও তাইহোকু বিমানবন্দরে কোনও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি।
শুধু মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টেই নয়, সম্প্রতি প্যারিসের ‘ইনস্টিটিউট দে হতে এতুদে ইকনমিকস এত কমার্শিয়েলস’-এর অধ্যাপক ঐতিহাসিক জে বি পি মোরে দাবি করেছেন, বিমান তাইহোকুর দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নেতাজি জীবিতও ছিলেন বলে দাবী করেছেন তিনি।
১৯৪৭-এর ১১ ডিসেম্বরের ফরাসি গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনি বলেন, ফরাসি গোয়েন্দা নথিতে কোথাও বলা নেই যে, তাইওয়ানের বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছে। বরং এই নথি থেকে স্পষ্ট, ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরেও জীবিত ছিলেন নেতাজি। ঐতিহাসিক মোরে বলেছেন, ওই ফরাসি গোয়েন্দা রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুভাষচন্দ্র ছিলেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের প্রাক্তন প্রধান এবং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের জাপানি সংযোগকারী সংগঠন হিকারি কিকানের সদস্য।
নেতাজি অনুরাগীদের বিশ্বাস, হয়তো বড় কোনও সত্যকে আড়াল করার জন্যই রহস্যের মোড়কে চাপা পড়ছে আসল তথ্য। ১২৩ বছর বয়সেও জীবিত রয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু, এমন আবেগতাড়িত কল্পনাকে প্রশ্রয় দিতে চান না কেউই। শুধু সত্যিটা জানতে চান তাঁরা, যা একাধিক কমিশনের রিপোর্ট আর শতাধিক অপ্রকাশিত নথির নিচে চাপা পড়ে রয়েছে আজও।