কতটা পথ পেরোলে তবে প্রতিবাদী হওয়া যায়…
সৌভিক রাজ
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: বাঙালির প্রতিবাদে রক্তকরবীর নন্দিনী এসেছেন, সুকুমার রায়ের হ য ব র ল এসেছে, নারায়ণ দেবনাথের আঁকা এসেছে, বড্ড গর্ব হচ্ছে। জাতটা স্বাধীনতা আন্দোলন করেছে, জোতদার-জমিদার হঠিয়ে আদায় করেছে হক, খাদ্য আন্দোলন করেছে আবার সাতের দশকে নকশাল আন্দোলনও করেছে। সাহেব পুলিশের গুলি থেকে জরুরি অবস্থা, কিছুই তাঁদের দমাতে পারেনি! আজও মশালে যে বারুদ বাড়ন্ত নয়, দেখে ভালো লাগছে। শহরের বুকে এক আরোগ্যনিকেতনে নিজের সম্ভ্রম খুইয়ে চলে গেলেন এক সম্ভবনাময় তরুণী। এ ঘটনা ক্রুদ্ধ করেছে বাঙালিকে, ঝাঁকুনি দিয়েছে। পথে নেমেছেন মানুষ। সে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত। বুকে তাঁদের বিপ্লবের লেলিহান শিখা। এমন বেপরোয়া মানুষকে ভয় পায় রাজনৈতিক শক্তিরা। তারা নেমেছে বেরি পরাতে। আন্দোলনের সামনে মুখোশ হয়ে উঠতে। গদি দখলের এ চক্রান্তে এখনও পা দেয়নি আম জনতার একাংশ। তবে নারীর অধিকারের লড়াইতে কেন নারীকেই আক্রমণের শিকার হতে হবে?
“এরকম তো কতই হয়” থেকে “ছোট্ট ঘটনা”; শাসক নিজের শাসনকালকে কন্টকহীন দেখাতে এমন বাণী নিক্ষেপ করবেনই। একদল কামদুনি দেখাবে, একদল ধানতলার দিকে আঙুল তুলবে, কেউ হাথরাস দেখাবে, কেউ কেউ তাপসী মালিকের কথা বলবেন, কেউ আবার অনীতা দেওয়ানের কথা বলবেন কিন্তু একজন বিচারপ্রার্থী মানুষ, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়তে আসা এক মানুষ কামদুনি বা কাঠুয়ায় বিভেদ করবেন না। যদি তিনি বিভেদ করেন তাহলে বুঝতে হবে, তিনি বিচার চাইতে লড়ছেন না। এ ঘটনাকে ঢাল করে তিনি লড়ছেন তাঁর ব্যক্তিগত কোনও ক্ষোভ বা উষ্মা মেটাতে।
আরজি করের ঘটনায় প্লাবনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভুয়ো খবর। তৈরি হয়েছে রিল, ভিডিও, শ্রুতি নাটক। মরা গাঙে জোয়ারের মতো ‘রিচ’ পেয়েছেন ইনফ্লুয়েন্সররা। নির্যাতনের শিকার হওয়া মেয়েটির ছবি, নাম, পরিচয় ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। আইনের তোয়াক্কা না-করে সচেতন, শিক্ষিত মানুষেরাই নিজেদের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব কাটাতে দিবারাত্রি তা পোস্ট করে যাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে। এর ফল কী? পর্ণ ওয়েবসাইটগুলোতে লোকেরা মেয়েটির নাম লিখে হয়নার মতো খুঁজে চলেছে নির্যাতনের ভিডিও। হয়তো অনুসন্ধানকারীদের কেউ কেউ মিছিলে হেঁটেও এসেছেন, হয়তো বিচারের দাবিতে লম্বা বক্তব্য পেশ করেছেন সমাজ মাধ্যমের পাতায়। করুন। ব্যক্তিস্বাধীনতা সেখানে হস্তক্ষেপ করা সমীচিন নয়। কিন্তু এ কোন সমাজ? ধর্ষণের বিচার চাইছে আবার একই সঙ্গে ধর্ষণ ক্যামেরা বন্দি হল কি-না তা খুঁজছে!
এক জনপ্রিয় মধ্যবয়সী অভিনেত্রীর মদ্যপানের ভিডিও সমাজ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ালো, তিনি আবার এক মহিলা সাংসদদের মদ্যপানের ছবি পোস্ট করে পাল্টা দিলেন। তারপর এলেন এক মহিলা সাংবাদিক, তিনিও জনপ্রিয়। পোস্ট-পাল্টা পোস্টের ঠান্ডাযুদ্ধ চলল। কোথাও যেন মহিলারাই একে অন্যকে আক্রমণ করলেন নারী নির্যাতনের বিচার চাইতে এসে।
ধর্ষণের হুমকি পেলেন মিমি চক্রবর্তী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা, ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এবং আরও কত কত জন। কেন পেলেন? চলছে তো নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ।
নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে নেমে এক মিছিলের আহ্বায়ক মহিলা সাংবাদিককে বললেন ‘চোপ!’, তিনি আবার যৌন নিগ্রহের অভিযোগে অভিযুক্ত! দেশ বিচিত্র বলে বারবার কেন সেলুকাসকে কেন ডাকব? আয়নায় নিজেদেরও দেখি! নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ থেকে চুড়ি পরার নিদান এল। পুলিশকে ঘাগড়া পরিয়ে, চুড়ি পরিয়ে নানান গ্রাফিক্স বানিয়ে ‘ট্রোল’ করা হল। যাঁরা করলেন তাঁরা কিন্তু সবাই এক মহিলার উপর হওয়া অন্যায়ের সুবিচার চাইছেন।
শঙ্খ বাজানোর পদ্ধতি থেকে কাঁদলেও কাজল কেন লেপ্টে যাচ্ছে না, এ’সব প্রশ্ন মহিলারাই তুলছেন! মহিলাকেই ট্রোল করছেন। ভাবতে অবাক লাগছে এ কোন প্রতিবাদী ছদ্মবেশ?
নালসার কমিশনের সুপারিশে রয়েছে, ধর্ষিতা বা তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাষ্ট্রকে। টাকার অঙ্কটাও বেঁধে দেওয়া। কিন্তু দেখুন প্রতিবাদের এমনই মহিমা, প্রতিবাদীরা বলছেন ‘মেয়ের দাম দশ লক্ষ টাকা’। ধর্ষণের ইচ্ছে প্রকাশ করে কেউ কেউ কুড়ি, পঁচিশ লক্ষ টাকা দিতে চাইছেন। মমতা রাজনীতির মানুষ, এ দেশে রাজনৈতিক নেতাদের গালাগাল দেওয়ার এক অলিখিত অনুমতি সনদ রয়েছে। নেতা, নেত্রীদের গালাগাল দিলে বেশ বাহবা মেলে। বুঝতে হবে নারী নিগ্রহের প্রতিবাদ করতে এসে নারীদের আক্রমণ করা যায় না। গ্রামীণ এলাকার, প্রান্তিক কোনও মহিলার ছবি এঁকে, তাঁর মুখে পাঁচশো টাকার নোটের ছবি আঁকাটা বিপ্লবের ভাষ্য নয়। হতে পারে না।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নেওয়া মহিলাদের আক্রমণ করলে সাময়িক তৃপ্তি জোটে কিন্তু নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ হয় কি? কারণ, প্রতিবাদী যে লড়াইটা করছেন বলে আপাতভাবে দাবি করছেন, সেটা তাঁদের জন্যেও। ফেসবুকে লাইক, শেয়ার পাওয়ার জন্য নয়। ভোটে লজ্জাজনক হার থেকে প্রতিবাদ, সবেতেই ওঁদের কারণ হিসাবে ঠাহর করে আক্রমণ করা হবে? ভাবুন ধর্মাবতার থুড়ি রাজনৈতিক সচেতন অরাজনৈতিক প্রতিবাদীরা।
মানুষ নিরপেক্ষ হন না। কোনও আন্দোলন নিরপেক্ষ হয় না। বিচার চাওয়ার এ লড়াইতেও মিশে আছে রাজনৈতিক মতাদর্শ। সেটা ব্যতিক্রমী নয়, সঙ্গত। কিন্তু একজনের প্রতিবাদের ভাষা ঠিক করে দিতে চাওয়াও মৌলবাদ। প্রতিবাদের সুর মিললেই তাঁর শিরদাঁড়া সোজা, অন্যথায় সে চটিচাটা, মাকু, চাড্ডি ইত্যাদি বিশেষণগুলো দেওয়াও তালিবানী ফতোয়া দেওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, ‘বাড়িতে মা, মেয়ে নেই? তাই প্রতিবাদ করছো না।’, ‘নিঃসন্তান তো তাই বুঝছো না।’, ‘তুমি তো ছেলের বাবা। তোমার আর কী?’ আদপে তাঁরা চাইছেন তাঁদের মতো করে প্রতিবাদ করুন বাকিরা। ফ্যাসিবাদী ভাবনা থেকে আপনার প্রতিবাদকে তাঁদের প্রতিবাদ বলে মনে হচ্ছে না। ‘পুলিশের মেয়ে বড় হচ্ছে’ বলার মধ্যে কী, প্রচ্ছন্নভাবে ওই মহিলা চিকিৎসকের মতো পরিণতি হওয়ার কামনা নেই? কারও কারও যুক্তি, ‘আমার মেয়ে আছে বলে প্রতিবাদ করছি।’ প্রতিবাদ করুন, অবশ্যই প্রতিবাদ করুন। এমন ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য মেয়ে থাকা বা না-থাকা কেন কারণ হতে যাবে? এটাও কি পিতৃতন্ত্রের সুক্ষ্ম আস্ফালন নয়?
প্রতিবাদের ভাষা হোক স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতন্ত্র। যে যেখানে পারেন, যেভাবে পারেন নিজের মতো লড়ে যান। শুধু মনে রাখুন আপনি লড়ছেন নারী সুরক্ষার দাবিতে, একটি মেয়ের উপর হওয়া অত্যাচারের বিচারে দাবিতে। যাঁদের জন্য লড়া তাঁদেরই ফের আক্রমণ করে বসবেন না। দেশ বড় অদ্ভুত, কত ধর্ষিতা অভিযোগই জানাতে পারেন না। কত মেয়ে এত বড় আন্দোলনের মঞ্চ পান না। আসিফা, বিলকিসদের তো অভয়া, নির্ভয়া নামটাও জোটে না। যিনি দধীচি হয়ে এ আন্দোলনের ভিত্তি গড়লেন, নিভন্ত চুল্লিতে আগুন দিলেন, তিনি সুবিচার পান। মেয়েরা নির্ভয়া হওয়ার থেকে বেঁচে যাক। বাসে, ট্রেনে, ভিড়ে পুরুষদের হাতগুলো কৃষ্ণের মতো হোক, দুর্যোধন, দুশাসনদের মতো নয়।