কবি জীবনানন্দ দাশের শেষ হেমন্ত-যাপনের কাহিনি
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: কবি জীবনানন্দ দাশের শেষের দিনগুলো চরম অর্থ সংকটে অতিবাহিত হয়েছিল। একটার পর একটা চাকরি হারিয়েছন, কলকাতার ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিটে ভাড়া থাকেতন। স্ত্রী লাবণ্যেদবীর অসুস্থতা-সহ পুরো পরিবারের ভার তাঁর কাঁধে, নিদারুণ অর্থকষ্ট ক্রমশ অসহায় করে তুেলিছল তাঁকে। অর্থকষ্ট খানিক লাঘব করেত, ভাড়াবাড়ির একটা ঘর একজন নর্তকীর কাছে ভাড়া দিয়েছিলেন। যা কবির নির্বিঘ্ন যাপনকে ভেঙে দিয়েছিল, সৃষ্টির ব্যাঘাত ঘটিছল। টিউশনি পড়িয়েছেন, বিমা কোম্পানির দালািল পর্যন্ত করেছেন। ভাই-বোন, ভাইেয়র বউ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাণী রায়, প্রতিভা বসুসহ আরও অনেক বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়, অনেকের কাছ থেকেই টাকা ধার নিয়েছিলেন। শোধ করেছেন, তাও আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে।
১৯৫৪ সালে ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন জীবনানন্দ দাশ। ওই দুর্ঘটনার কারণেই ২২ অক্টোবর শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৪ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিজের জীবেনর শেষ হেমন্ত যাপন করেছেন কবি। সেখানেই হয়ত জীবেনর শেষে শিউিল ছাতিমের গন্ধ পেয়েছেন কবি, মেখেছেন ভােরের শিশির। ১৪ অক্টোবর, দিব্যি সুস্থ তিনি। প্রতিদিনই বেড়াতে যাওয়ার জন্য পৌঁছে যেতেন সুবোধ রায়ের বাড়িতে। সুবোধ রায় ইনফ্লুেয়ঞ্জা জ্বরে কাবু, অগত্যা একাই হাঁটতে বের হয়েছিলেন।
সুবোধ রায় বাড়ি থেকে বেরোলেন একটু দেরি করে। হঠাৎই তাঁর কাছে দৌড়ে এল একটি ছেলে। ছেলেটির নাম রঞ্জু। সে এসে বললে, জানেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাবাকে এইমাত্র হাসপাতাল নিয়ে গেল। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের কাছে জলখাবার এবং জুয়েল হাউস দোকানের সামেন অন্যমনস্কভাবে রাস্তা পার হচ্ছিলেন, তখন তাঁর অ্যাক্সিডন্ট হয়। রাস্তা পেরােনোর সময় চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম সাপোর্টিং স্টেশন থেকে সবে মাত্র বের
হচ্ছে, তখনও রঞ্জুর বাবার থেকে পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে ট্রাম। অবিরাম ঘণ্টা বাজছে, সতর্কবাণী ঘোষণা করে বারবার সাবধান করে দিচ্ছেন ট্রাম চালক। ট্রাম এসে পড়ল মানুষটির সামনে। ব্রেক কষলেন ট্রামচালক, ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। রঞ্জুর বাবার দেহ আটকে গিয়েছে ট্রামের ক্যাচারের ভিতরে। রক্তাক্ত হয়ে তিনি অচৈতন্য। বুক, হাত, ডান চােখের কােণ তীব্র আঘাত লাগল। দেহের সর্বত্র থেতলে গিয়েছে। বুকের পাঁজরের অনকগুলো হাড় ভেঙে গিয়েছে। গুঁড়িয়ে গিয়েছে উরুর হাড়। টেনে হিঁচড়ে কোনওরকমে রঞ্জুর বাবার দেহ বের করে আনল সবাই।
এক প্রত্যক্ষদর্শীেদর বয়ান অনুসাের, ডাউন বালিগঞ্জ ট্রামটির ক্যাচারও ভেঙে গিয়েছিল, ট্রামের সামনের কিছুটা অংশও চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে ধরাধরি করে রাস্তার অন্য পারে নিয়ে গেলেন কবিকে। রাস্তার পথচারীরা, দোকানদারেরা তাঁর মুখ-হাতে জল দিলেন, বাতাস করেলন, পাশের দোকান থেকে বরফ এনে কোনও এক পথচারী তাঁর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে বুলিয়ে দিলেন। এরপর তাঁর জ্ঞান ফিরল, ঘিরে থাকা ভিড়ের উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন করেলন , ‘কী হয়েছে? আমি এখানে কেন?’ একজন উত্তর দিল, ‘হাঁটেত হাঁটেত মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।’ ফিরতি প্রশ্নের পালা, এক ভদ্রেলাক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার নাম কী? ঠিকানা কী?’ ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলেন, ‘জীবনানন্দ দাশ। ১৮৩, ল্যান্সডাউন রোড।’ তারপর বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠতে গিয়ে আবার পড়ে গেলেন।
তাঁকে ট্যাক্সিতে তুললেন, ওই ট্রামের এক যাত্রী জনৈক বিমলেন্দু শীল, জলখাবার দোকানের মালিকের ভাই চুনীলাল দে, একজন পুলিশসহ আরও দু-একজন উঠেলন সেই ট্যাক্সিতে। গন্তব্য শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে দুর্ঘটনার খবর দিলেন জলখাবার দোকানের মালিক। ট্যাক্সি পৌঁছল হাসপাতালে। কবি ভর্তি হলেন ২নং ওয়ার্ড।
বিমলেন্দু শীলের কথায়, ‘শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের দুনম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় তাঁকে। খবর পেয়ে দেখতে আসেন কবিকে। এসে পড়েন কবির নিকট আত্নীয় স্বনামধন্য চিকিৎসক শ্রী অমল দাশ এবং খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এ.কে.বসু। ডাক্তার অমল দাশকে দেখেই কবি, বলে উঠেছিলেন, কে বুবু? বুবু এসেছিস? বাঁচিয়ে দে…। বুবু সে যাত্রায় বাঁচাতে পারেননি।
১৭ অক্টোবরের ঘটনা, হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের ২নং ওয়ার্ডে এলেন কবি-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। কবির কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত তখন ব্যান্ডেজ বাঁধা। মুখ ফুলে বিকৃত হয়ে রয়েছে, চেনার কোনও উপায় নেই। সজনীকান্ত দাশের অনুরােধে, পরিদন বিধানচন্দ্র রায় দেখতে আসেবন। ২২ অক্টোবর থেকে কথা বন্ধ হয়ে গেল। যবনিকাপাত হল জীবনান্দের জীবনের।