বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

আজ শ্রীশ্রী সারদা দেবীর ১৭২ তম আবির্ভাব তিথি, কেমন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের মা?

December 22, 2024 | 3 min read

আজ শ্রীশ্রী সারদা দেবীর ১৭২ তম আবির্ভাব তিথি, কেমন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের মা?

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: জঠরে ধারণ করলেই কি মা হওয়া যায়? জৈবিক মাতৃত্বের সংজ্ঞা ভেঙে সকলের মা হয়ে উঠেছিলেন মা সারদা। শ্রীশ্রীমা সারদা সঙ্ঘজননী মাতৃ স্বরূপিণী পরমা প্রকৃতি। সারদাদেবীর বৌদ্ধিক মূল্যায়ন করতে গেলে এক আধুনিকমনস্কা নারীর হদিশ পাওয়া যায়। যে বিদেশিনী বিধর্মীকে মেয়ে বলে বুকে টেনে নিতে পারেন। হয়ে উঠতে পারেন শত সহস্র সন্তানের জননী। তার্কিক বাস্তবমুখী চেতনার আলোকপাতে তাঁকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যে অনন্ত। অসীম।

সারদাদেবী সামাজিক কাজকর্মে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন কম। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের মতো তাঁর কোন উপদেশ সংকলনও প্রকাশ হয়নি। তিনি বাগ্মী ছিলেন, এমন দাবিও কেউ কখনও করেননি। কিন্তু অবগুণ্ঠিতা অন্তরালবর্তিনী হয়েও তিনি ছিলেন চালিকা শক্তি। রামকৃষ্ণ সৌরমণ্ডলের সূর্য।

​১৮৮৬ সালের আগস্ট মাসে শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিধবার বেশ ধারণ করতে গেলে দিব্যদর্শনে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে নিরস্ত করে বলেন, “তিনি মারা যাননি, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গিয়েছেন কেবল।” এরপরেই মায়ের সঙ্ঘজননী হয়ে ওঠা।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রয়াণের দুই সপ্তাহ পরে লক্ষ্মী দেবী, গোপাল মা প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহস্থ ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরসহ কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রা করেন সারদা দেবী। জনশ্রুতি রয়েছে, বৃন্দাবনেই সারদাদেবীর নির্বিকল্প সমাধি লাভ হয়। সেখান থেকেই সঙ্ঘজননী মা হয়ে ওঠা জীবনের সূত্রপাত হয়। এরপর কয়েকমাস কামারপুকুরে অতিদুঃখকষ্টের জীবন কাটান মা। ১৮৮৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যরা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। স্বামী সারদানন্দ বাগবাজারে তাঁর জন্য স্থায়ী বাসভবন নির্মাণ করেন। যা আজও ‘মায়ের বাড়ি’ নামেই পরিচিত। জয়রামবাটীর পর সারদাদেবীর জীবনের দীর্ঘতম সময় অতিবাহিত হয়েছিল এখানেই।

শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যোগেন মহারাজ প্রমুখদের তিনি এখানেই দীক্ষা দান করেন। শিষ্য ও ভক্তদের নিজের সন্তান বলে মনে সারদা মা। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত বাগবাজারে তাঁর দর্শন, উপদেশ ও দীক্ষালাভের আশায় ভিড় জমাতেন। তাঁর মাতৃসমা মূর্তি ও মাতৃসুলভ ব্যবহার সকলকে মানসিক শান্তি দিত। অপরদিকে, মা শ্যামাসুন্দরীদেবীর মৃত্যুর পর বিধবা ভাতৃ জায়া সুরবালা ও তাঁর রাধারানি বা রাধু নামক একগুঁয়ে এবং মানসিক বিকারগ্রস্থ সন্তানের ভারগ্রহণ করেন সারদা দেবী। মায়ের মতোই ধৈর্যসহ রাধুর যত্ন করতেন সারদা দেবী। বলা হয়, কয়েকজন শিষ্য তাঁর দর্শনলাভের পর আধ্যাত্মিক অনুভূতিপ্রাপ্ত হন, অনেকে তাঁর সাক্ষাৎ দর্শনে দেবীরূপে তাঁর দর্শনলাভ করেন। আবার কেউ স্বপ্নে তাঁর থেকে দীক্ষালাভ করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সারদা দেবীকে ঠাকুরের শিষ্যেরা নিজেদের জননীর আসনে বসিয়েছিলেন। তাঁর উপদেশ ও উৎসাহ লাভের আশায় তাঁরা বারবার ছুটে আসতেন। স্বামী নিখিলানন্দ, স্বামী অশেষানন্দ, স্বামী বিরেশ্বরানন্দ এবং স্বামী বিরজানন্দ ছিলেন তাঁর প্রধান শিষ্য। নারীশিক্ষায় বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন সারদা দেবী, ভগিনী নিবেদিতাকে তাঁর নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।

সারদা দেবী রামকৃষ্ণ সংঘ ও ভক্তসমাজে সর্বাধিক শ্রদ্ধার আসনটি লাভ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁকে নিজের প্রয়াণের পর রামকৃষ্ণ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভক্তদের বলেছিলেন সারদা দেবীই সব। নিজেও তো ফলহারিণী অমাবস্যায় পুজো করেছিলেন। আদপে তিনিই ছিলেন সাক্ষাৎ জগদম্মা যার স্বরূপ রামকৃষ্ণ দেব উপলব্ধি করেছিলেন।

১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে সারদা দেবী জয়রামবাটী যাত্রা করেন। একবছর সেখানে কাটান। এর মধ্যে অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন তৈরি হয়েছে। বিশ্বজয় করে নরেন ফিরে গিয়েছেন রামকৃষ্ণ লোকে, তাঁর মানস কন্যা নিবেদিতাও নেই। বেলুড় যে মহিরূহ হবে তার প্রমাণ মিলেছে। মার শরীরও ভাঙতে শুরু করল। শেষ তিনমাসে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। ১৯২০ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি অশক্ত অবস্থায় মাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। এরপর প্রায় পাঁচমাস রোগযন্ত্রণা ভোগ করে ১৯২০ সালের ২০ জুলাই রাত দেড়টায় কলকাতার উদ্বোধন ভবনে সারদা দেবীর মৃত্যু হয়। বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে যে স্থানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল, সেখানেই বর্তমানে গড়ে উঠেছে শ্রীমা সারদা দেবীর সমাধিমন্দির। মৃত্যুর আগে এক শোকাতুরা শিষ্যাকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখ। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার। আসলে তিনিই তো জগন্মাতা, শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে। পৃথিবীকে লালন করতে, ধারণ করতেই তাঁর আগমন। ঠাকুরের সন্তানদের পথপ্রদর্শক হয়ে তিনিই এগিয়ে দিলেন রামকৃষ্ণ আন্দোলনকে। যা তার ব্যাপ্তি আমাদের মুগ্ধ করে। সন্তানদের বেঁধে রাখার সুতো হয়েই রামকৃষ্ণ মঠ মিশন এবং রামকৃষ্ণ আন্দোলনের বুনোট মজবুত করে গিয়েছেন মা। তাই তো তিনি সতের মা, অসতেরও মা, সত্যিকারের মা, জননী।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Sri Sarada Devi, #sarada ma, #Abirbhab Tithi

আরো দেখুন