বঙ্গ রাজনীতিতে জাতীয় স্তরের ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ শিবাজীর পরিবর্তে বাঙালি হিন্দুর নিজস্ব ‘হৃদয়সম্রাট’ শশাঙ্কের আবির্ভাব ঘটাচ্ছে গেরুয়া শিবির

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ছত্রপতি শিবাজীকেও বাঙালি মননে প্রবেশ করানোর চেষ্টা হয়েছে। ঘটা করে রামনবমী উদযাপন করে বঙ্গে রাম আবেগ তৈরির চেষ্টা হয়েছে। শ্রীরাম ব্যতীত একমাত্র রাজপুরুষ, যাঁকে বিজেপি গোটা দেশের সামনে ‘সুশাসনের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে, তিনি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ। কিন্তু সেই ‘অপ্রতিরোধ্য’ ঘোড়াটির লাগাম বঙ্গের সীমানায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ যেন টেনে ধরে। বার বার বর্গি হানার আখ্যান মনে করিয়ে দেওয়া হয়।
জাতীয় স্তরের ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’কে ছেড়ে তাই বাঙালি হিন্দুর নিজস্ব ‘হৃদয়সম্রাট’ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে পশ্চিবঙ্গে। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের জয়ধ্বনিতে মনোনিবেশ করেছে বাংলার বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার।
বস্তুত বাংলার মনে হিন্দুত্ব জাগাতে ভিনরাজ্যের হিন্দু বীর দিয়ে যে বিশেষ কাজ হচ্ছে না, সেটা সম্ভবত অনুধাবন করতে পেরেছে আরএসএস এবং বঙ্গ বিজেপি। সেজন্যই সন্ধান শুরু হয়েছে বাংলার নিজস্ব হিন্দুহৃদয় সম্রাটের। সেই তল্লাশি অভিযানে প্রথম যে নামটি উঠে এসেছে, সেটি হল গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক।
মহারাজ শশাঙ্ককে বাংলার হিন্দু জাগরণের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরে প্রচার শুরু করছে বিজেপি। বাংলার সালগণনা অর্থাৎ বঙ্গাব্দ গণনার প্রবর্তক কে? এ নিয়ে দ্বিমত আছে ইতিহাসবিদদের। কেউ কেউ মনে করেন, বঙ্গাব্দের প্রবর্তক ছিলেন শশাঙ্ক। কারও কারও মতে, মোগল সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিজেপি তথা আরএসএসের একাংশ বাংলায় জোরের সঙ্গে প্রচার করেছে বঙ্গাব্দের সূচনা করেছেন শশাঙ্কই। তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় থেকেই বঙ্গাব্দ গণনা শুরু। সেটা প্রমাণ করতে গত কয়েক বছর ধরে কল্পিত ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করছে সংঘ।
নতুন বছরের আগে গত কয়েক বছর ধরে বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদের ব্যানারে শশাঙ্কের সম্মানে কলকাতায় একটি শোভাযাত্রাও করা হয়। এ বছরও সেটা করা হবে। বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা প্রবীর ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক সম্পর্কে বঙ্গ সমাজে সচেতনতা জাগাতে তাঁরা গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। এমনিতে ইতিহাসবিদরা শশাঙ্কের কোনও মূর্তি বা ছবি এখনও খুঁজে পাননি। তবে ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রমেশচন্দ্র মজুমদারের বর্ণনা শুনে বছর চারেক আগে শশাঙ্কের একটি ছবি বানানো হয়। সেই ছবিই এবার ক্যালেন্ডারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এবার অবশ্য ক্যালেন্ডারে সীমাবদ্ধ থাকা হবে না। আগামী ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ ঘটা করে এবারও শশাঙ্ককে নিয়ে শোভাযাত্রা করা হবে। তবে তাঁরও আগে যেটা করা হবে সেটা হল শশাঙ্কের মূর্তি প্রতিষ্ঠা।
কিন্তু শিবাজির বিকল্প হিসেবে শশাঙ্কের ‘বিগ্রহ’ প্রতিষ্ঠার কথা কী ভাবে মাথায় এল? এর ব্যাখ্যা বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের কেউ প্রকাশ্যে দিতে রাজি নন। তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ এক লেখকের কথায়, ‘‘প্রথমত, গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ঘোষিত ভাবে শিব উপাসক ছিলেন। শিবাজিও তা-ই ছিলেন। দ্বিতীয়ত, শিবাজি যেমন মোঘল আধিপত্যের বিরুদ্ধে হিন্দু রাজা হিসেবে লড়েছিলেন, তেমনই শশাঙ্কও বৌদ্ধ আধিপত্যের মাঝে হিন্দু রাজা হিসেবে মাথা তুলেছিলেন। তৃতীয়ত, শশাঙ্কের পরে বাংলায় আর এমন কোনও উল্লেখযোগ্য রাজশক্তি মাথা তুলতে পারেনি, যারা একাধারে বাঙালি এবং হিন্দু ছিল। পাল সাম্রাজ্য ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। আর সেনরা ছিলেন দক্ষিণী। তাই বাঙালি হিন্দুর নিজস্ব ‘হৃদয়সম্রাট’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করতে হলে শশাঙ্কই আদর্শ চরিত্র।’’