রাজ্য বিভাগে ফিরে যান

বাংলার রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে বসা ‘সৌজন্য’ যেন ফিরে এল দিলীপ ঘোষের বিয়েকে কেন্দ্র করে

April 19, 2025 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলায় এখন রাজনৈতিক সৌজন্যের আকাল। শুধুই যেন কুকথার আধিক্য। বাংলার রাজনীতিতে কুকথার এইসব নমুনা আমরা প্রথম দেখছি, এমন নয়। আগেও বিভিন্ন সময়ে কুকথা নিক্ষিপ্ত হয়েছে পরস্পরের প্রতি। কিন্তু সে প্রবণতাকে ছাপিয়ে গিয়ে প্রাধান্য বজায় রেখেছে রাজনৈতিক রুচিশীলতা। চটুল বা সস্তা মন্তব্য আগেও বিভিন্ন রাজনীতিকের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি করে পাওয়া গিয়েছে গভীর রাজনৈতিক কথা।

পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি একটা দীর্ঘ সময় ধরে বিভক্ত ছিল দুটি রাজনৈতিক মেরুতে। বাম ও কংগ্রেস। দুই শিবিরের মধ্যে তিক্ততাও ছিল অপরিসীম। ফলে কুকথাও নিক্ষিপ্ত হয়েছে অনেকবারই। তৃণমূল গঠিত হওয়ার পরেও সে ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু আকথা-কুকথার স্রোতকে পিছনে ফেলে মানুষের উন্নতির পন্থা-পদ্ধতিই ছিল প্রধান আলোচ্য তখনও। মানুষের ভাল কিসে, শিল্পে, নাকি কৃষিতে, তা ছিল সে সময়ের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে। দিন যত গিয়েছে, প্রবণতা তত নিম্নগামী হয়েছে বাংলায়। গভীর রাজনৈতিক মন্তব্য সম্প্রতি বড্ড কম। চটুল কটাক্ষ, সস্তা বক্তব্য, ইত্যাদিরই রমরমা যেন।
অন্য অনেক কিছুর মতো বঙ্গ রাজনীতি থেকে সৌজন্য হারিয়ে যাচ্ছে বলে সকলে যখন নানান সময়ে হা হুতাশ করছেন, তখন দিলীপ ঘোষের বিয়ে কিন্তু একটা নতুন বার্তা দিয়ে গেল। বিজেপি’র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতির কুকথার জন্য বেশ ‘সুনাম’ রয়েছে। কিন্তু তিনি যখন জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছেন তখন কিন্তু তাঁর বিরোধী বলে পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা প্রাণ ভরে শুভেচ্ছা জানালেন, সব রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে। এটাই তো বাংলার ঐতিহ্য। যা হারিয়ে যেতে বসেছিল।

১৯৮৪ সালের কথা। সিপিএম প্রার্থী বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সেবার যাদবপুরে কংগ্রেসের প্রার্থী এক তরুণী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনের বয়সের ফারাক বিস্তর। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়েও সোমনাথ কয়েক যোজন এগিয়ে।
সোমনাথবাবুর বাড়ি দক্ষিণ কলকাতার রাজা বসন্ত রায় রোডে। এক সকালে ওই এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচার করছিলেন মমতা। সেই সময় বাড়ি থেকে প্রচারের উদ্দেশে বের হন সোমনাথবাবু। মমতা জানতে পারেন উনিই তাঁর প্রতিপক্ষ। যাঁর বিরুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় বুঝে দলের কেউ প্রার্থী হতে চাননি। আজকের মুখ্যমন্ত্রী সেদিনের তরুণী মমতা ছুটে গিয়ে সোমনাথবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন। বলেছিলেন, “আমাকে আশীর্বাদ করুন যেন জিততে পারি”। সোমনাথবাবু গোড়ায় খানিক অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়লেও নিজেকে সামলে নিয়ে শুভেচ্ছা জানান কংগ্রেস প্রার্থীকে। তারপর সবই অবাক করা ইতিহাস।

আবার জনশ্রুতি আছে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় গাড়িতে যেতে যেতে একদিন দেখলেন, বিরোধী দলের দাপুটে নেতা জ্যোতি বসু রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন তাঁরই বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ সভায় যোগ দিতে। ডক্টর রায় জানলা দিয়ে বললেন, ‘জ্যোতি, গাড়িতে উঠে এসো, কিছু খেয়ে নাও। খালি পেটে তো বিধান রায়ের সঙ্গে লড়তে পারবে না।’ এই কাহিনী শুনে চোখে জল আসে না, এমন ভদ্রলোক কেউ আছেন?

আবার সম্প্রতি মূলধারার একটি টিভি চ্যানেলে উৎসবের দিন গিটার হাতে আনন্দ করে একসঙ্গে গান গাইলেন, ফুর্তি করলেন এমন দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যাঁরা সচরাচর খুবই ঝগড়া করে থাকেন। সিপিআই(এম) দলের তরুণ তুর্কি কমরেড শতরূপ ঘোষ এবং, তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রী কুণাল ঘোষ। একদিনের জন্য ঝগড়া ছেড়ে এই ভাব-ভালবাসার জোয়ারে ভেসে গেল কলকাতা।

শুক্রবার দিলীপ ঘোষের বিয়ে উপলক্ষে বাংলার রাজনীতিতে সেরকমই সৌজন্যের নজির তৈরি হল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পাধ্যায় থেকে রাজনীতিতে দিলীপের বিরোধী বলে পরিচিত অনেকেই শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ফুলের তোড়া পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সঙ্গে দিলীপের নিউ টাউনের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী পাঠিয়েছেন শুভেচ্ছাবার্তাও। রাজ্য সরকারের ছাপযুক্ত হলুদ রঙের খাম পৌঁছেছে নিউ টাউনে। তাতে সাদার উপর কালো ছাপার হরফে দিলীপের নাম এবং ঠিকানা লেখা।

সোশ্যাল মাধ্যমে দিলীপ-রিঙ্কুকে শুভেচ্ছা জানালেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। টুইটে নব দম্পতির উদ্দেশে অভিষেক লিখেছেন, ‘নতুন জীবন সুন্দরভাবে শুরু করার জন্য দিলীপ ঘোষ ও রিঙ্কু মজুমদারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। ভালবাসার নিজস্ব সময় ও লয় থাকে। আপনাদের একসঙ্গে পথচলা সেই সত্যিকারের ভালবাসারই প্রমাণ। আপনাদের জীবনে যেন আনন্দ, শান্তি ও সহচর্য চিরকাল স্থায়ী হয়—এই শুভকামনা রইল’।

শুধু মমতা, অভিষেক নন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে কালবৈশাখীর ঝড়কেও পিছনে ফেলে দিয়েছে দিলীপ ঘোষের বিয়ের ‘খবর’! তখন থেকেই বঙ্গ রাজনীতির যাবতীয় আকর্ষণ ঘোষবাবুর বাড়ির দিকে! বিয়ের প্রতিটি মুহূর্তের আপডেট সম্প্রচার হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে বাম, ডান, নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মীরাই দিলীপবাবুর নতুন জীবনের শুভ কামনা করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে বাংলার রাজনীতিতে ফের দেখা গেল হারিয়ে যেতে বসা সেই ‘সৌজন্য’।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#West Bengal, #marriage, #dilip ghosh, #politics, #wedding, #Rinku Majumder

আরো দেখুন