বিপর্যস্ত কলকাতায় চলছে গাছ সড়ানোর কাজ
রাতের অন্ধকারেই আঁচ পাওয়া গিয়েছিল কতটা মারাত্মক হতে চলেছে আম্পানের রাক্ষুসে কামড়। সকাল হতেই সামনে এল গোটা রাজ্য জুড়ে দানবীয় সাইক্লোনের রেখে যাওয়া দগদগে ক্ষত! দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে থাকে একের পর এক মৃত্যুর খবর, ক্ষয়ক্ষতির খবর।
নবান্ন সূত্রে খবর, গোটা রাজ্যের খুব অল্প অংশের ক্ষয়ক্ষতির ছবিই সামনে এসেছে এখনও পর্যন্ত। কারণ, বহু এলাকাই এখনও পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ নেই। টেলি যোগাযোগ ব্যাবস্থাও সম্পূর্ণ ভাবে বিপর্যস্ত। সেই টুকরো টুকরো ছবিগুলো জোড়া লাগালে সামনে আসছে এক ভয়ঙ্কর ছবি। যার বীভৎসতা হার মানাচ্ছে আয়লার ধ্বংসলীলাকেও।
আমপান ১০০ কিলোমিটারের বেশি বেগে কলকাতার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল আক্রোশে উপড়ে দিয়ে যায় অসংখ্য গাছ। কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সমস্ত প্রান্তেই বড় রাস্তা হোক বা গলি— অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে উপড়ে যাওয়া গাছে। শহরের মধ্যেই দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিভিন্ন এলাকা।
বৃহস্পতিবার সকালে দেখা যায়, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপর কেসি দাস মোড় থেকে শ্যামবাজারের দিকে এগোলে, কয়েকশো মিটার অন্তর অন্তর পড়ে রয়েছে উপড়ে যাওয়া গাছ। রামমন্দিরের কাছে গাছের মতোই উপড়ে গিয়েছে রাস্তার পাশে ফুটপাথের একটি মন্দির।
একই ছবি লেনিন সরণি, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, গণেশ অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, পাটুলি, যাদবপুর, বাঘাযতীনে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা এ দিন সকালে বলেন, ‘‘গোটা শহর জুড়ে কত গাছ উপড়েছে তা হিসাব করা যাচ্ছে না।” কেবল, ট্রামের তার বা কোথাও ফুটপাথের একাংশ শুদ্ধ রাস্তায় একের পর এক বট, অশ্বত্থ, কৃষ্ণচৃড়া, রাধাচূড়া গাছ। ঝড়ের দাপটে উপড়ে গিয়েছে একের পর এক বাতি স্তম্ভ, সিগন্যাল পোস্ট। কোথাও গাছ বা পাঁচিল ভেঙে পড়়েছে পার্ক করা গাড়ি বা বাসের উপর।
প্রায় সাড়ে ন’টা নাগাদ একের পর এক জায়গায় ইলেকট্রিক করাত দিয়ে বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়ি কেটে পরিষ্কার করতে শুরু করেন দমকল, কলকাতা পুলিশ এবং পুরসভার কর্মীরা। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই সন্দিহান কত ক্ষণ বা কত দিনে সমস্ত গাছ কেটে রাস্তা পরিষ্কার করা যাবে!
একই ছবি কলকাতা সংলগ্ন হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার শহরাঞ্চলে। গাছ পড়ে অবরুদ্ধ বিটি রোডের একটা বড় অংশ এবং যশোহর রো়ড। সেই সঙ্গে এ দিন সকালেও জলমগ্ন রয়েছে এজেসি বসু রোড, ভিআইপি রোড, যশোহর রোডের বিভিন্ন অংশ। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা কলকাতা শহরের ছবি দেখিয়েই বলেন, ‘‘এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামাঞ্চলের অবস্থা কতটা ভয়ঙ্কর!”
বুধবার আবহাওয়া দফতর জানিয়েছিল সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে দমদম বিমানবন্দর এলাকার উপর দিয়ে আমপান বয়ে গিয়েছে ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার বেগে। সকাল হতেই দেখা যায় আমপান লন্ডভন্ড করে দিয়েছে গোটা বিমানবন্দর। সূত্রের খবর, বিমানবন্দরের টার্মিনালের অনেক কাচ ভেঙে গিয়েছে ঝড়ের দাপটে। কিন্তু আসল ক্ষতি হয়েছে রানওয়ে এবং বিমান রাখার হ্যাঙারে। রানওয়েতে জল জমার পাশাপাশি জমা জলে আধডোবা হয়ে রয়েছে হ্যাঙারে থাকা বিমানগুলি। সেই ক্ষতির পরিমাপ করা এখনও সম্ভব হয়নি বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের।
অবরুদ্ধ শহরে আমপান বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গিয়েছে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও। রাত থেকেই গোটা রাজ্যের বিভিন্ন অংশে মোবাইল পরিষেবা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শহর থেকে জেলা সমস্ত জায়গাতেই বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ পরিষেবা। অন্য দিকে খবর পাওয়া গিয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায় নদীবাঁধ ভেঙে ভেসে গিয়েছে একের পর এক এলাকা। কিন্তু সেখানকার প্রকৃত ছবি এখনও সামনে আসেনি। এখনও কার্যত বিচ্ছিন্ন ওই দুই জেলার অনেকটা অংশ। জানা যায়নি সেখানকার হতাহতের খবরও।
খুব প্রাথমিক ভাবে রাজ্যের উপকূলবর্তী তিন জেলা প্রশাসনের হিসাব, হাজার হাজার কাঁচা বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। নিরাশ্রয় হয়েছেন লাখো লাখো মানুষ। ধ্বংস হয়ে গিয়েছে চাষের মাঠ, পানের বরোজ, সব্জির খেত। বুধবারই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সকালের ছবিটা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে বলে প্রশাসনের কর্তাদের দাবি। পুরো ছবি পেতে আরও অনেকটা সময় লাগবে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। তবে আয়লার বীভৎসতাকেও আমপান ছাপিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে তাঁদের সংশয় নেই।