নজরুলের রাজনীতি ও দর্শন
বিশ শতকের প্রথমার্ধে, বিশেষত:প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের মধ্যবর্তী সময়ের অস্থির,উত্তাল তরঙ্গময় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, বাংলা কাব্যসহিত্যে যে ক’জন স্রষ্টা তাদের কলমকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নামটি অবশ্যই কাজী নজরুল ইসলাম।
তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে জাতপাত, ধর্ম, বর্ণভেদ,সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সমাজের জন্য একটি ভয়ংকর দুষ্ট ক্ষত যা লক্ষ্য পূরণে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আর এর বিরুদ্ধে তার চেতনা ও কলমকে এসবের উর্দ্ধে সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতার এক বিশ্বাসযোগ্য স্তরে উন্নীত করেছিলেন।
তাঁর কথাতেই, “এক অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি,এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য বাদকের একজন আমি–“। এই তূর্য বাদনের চারণভূমিতে দেখতে পান, “হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি,জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ-” আর বলে ওঠেন, “আমি হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাতে চেয়েছিলাম-“।
নজরুল ব্যাক্তি জীবনেও বিয়ে করেছিলেন হিন্দু রমণী,ছেলেদের নাম রেখেছেন সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ। তাঁর রচনার পরতে পরতে পাই উদার,অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ একজন মানুষ ও স্রষ্টাকে। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, এই জিজ্ঞাসে কোন জন, কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’।
এই ছিল কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তাধারা। তিনি বার বার ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। গেয়েছেন সাম্যের গান। তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম৷ যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব৷ আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি৷’
হিন্দু-মুসলমানকে সাম্প্রদায়িকভাবে ভাগ করার ইংরেজদের রণনীতির তিনি বার বার বিরোধিতা করেছেন। তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ছড়িয়েছেন ভ্রাতৃত্বের বাণী। ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসালমান।’
তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘এত মারামারির মধ্যে এইটুকু ভরসার কথা যে, আল্লা ওরফে নারায়ণ হিন্দুও নন, মুসলমানও নন। তার টিকিও নেই, দাড়িও নেই। একেবারে ‘ক্লিন’। টিকি-দাড়ির ওপর আমার এত আক্রোশ এই জন্য যে, এরা সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষকে যে, তুই আলাদা আমি আলাদা। মানুষকে তার চিরন্তন রক্তের সম্পর্ক ভুলিয়ে দেয় এই বাইরের চিহ্নগুলো।
সাম্যের গান গেয়ে তিনি বলেছেন ‘গাহি সাম্যের গান—/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।’
সম্প্রীতির প্রত্যাশায় নজরুল লেখেন:
‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা/ ভাঙি’ মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/ এক মানবের একই রক্ত মেশা/ কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।’