ফিরে দেখা একুশ: রাজনীতির সাত-সতেরো
একুশের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করতে একটি বাক্যই যথেষ্ট, “বছর ভর, সবুজ ঝড়”। কেটে গেল রাজ্য রাজনীতির এক ঘটনাবহুল বছর ২০২১! প্রত্যাবর্তন নাকি পরিবর্তন? কী হতে চলেছে রাজ্যের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, এই প্রশ্নেই শুরু হয়েছিল বছর। কিন্তু একুশের শেষে দাঁড়িয়ে বলাই যায়, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের তকমা ছিনিয়ে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১) তৃণমূলের জয় জয়কার:
২০২১-এর বাংলা তিনটি নির্বচান দেখেছে। একুশের মহারণ বিধানসভা ভোট, তার পরে দুটি পর্যায়ে উপনির্বাচন এবং সব শেষে ডিসেম্বরের মহানগর দেখেছে পৌর নির্বাচন। রাজনীতির মৌখিক কাজিয়া-তরজা এক্কেবারে চরম পর্যায়ে দেখে ফেলেছে বাংলার মানুষ। কিন্তু সব কিছুকে পরাজিত করে প্রত্যাবর্তন করেছেন বাংলার ঘরের মেয়ে। অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে জোড়াফুল।
দলীয়ভাবে তৃণমূলের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধির বছর হয়ে থাকল ২০২১। বাংলার পরে ত্রিপুরা, গোয়া, মেঘালয়, মনিপুর, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে ক্রমশ শক্ত হচ্ছে ঘাস ফুলের জমি। বাংলার মেয়ে, দেশের দিদি হয়ে উঠেছেন। বিন্ধ্য পর্বতের ওপাশ থেকেও দিদির নামে আওয়াজ উঠছে।
২) হারাধনের সন্তান বিজেপি:
২০১৯-এর পর থেকে রাজ্যে পরিবর্তনের ডাক দেওয়া বিজেপি, ২০২১-এ এসে কেমন যেন কানা গলিতে পথ হারিয়ে ফেলা এক পথিক। মোদী-শাহ আর দিল্লির নেতাদের ২০০ পারের ডাককে ৭৭-এ থামিয়েছেন বাংলার মানুষ। থমকে গিয়েছে বঙ্গ বিজেপি! স্রোত এখন উল্টো দিকে, নিত্যদিন ফুল বদল করছেন নেতারা। অভিযোগ-কোন্দলে পদ্ম বাগান বিধ্বস্ত। হেস্টিংসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। হারাধনের ছেলের মতোই বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।
৩) শূন্য থেকে শুরু, বাম:
স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রথম বাম শূন্য বিধানসভা। ধূমকেতুর মতো উত্থান হওয়া আইএসএফ-এর হাত ধরে তারা ডুবল, এমনটাই বলেন নিদুকেরা। ব্রিগেডেই তাল কেটে গিয়েছিল জোটের। আদপে বামেরা ফেসববুকের দেওয়ালে ঠেকেছে, তাই ফলও হয়েছে অন্তরসার শূন্য। সুজন, সেলিমরা এখন সিনিয়ার সিটিজেনদের রিজার্ভ বেঞ্চে বসানোর কথা ভাবছেন। যদিও বিধানসভায় তরুণ ব্রিগেড নামিয়েও কাজ হয়নি। তবে তাদের জন্য সুসংবাদ। কলকাতা পৌর নির্বাচনে, বিজেপিকে পিছনে ফেলে ভোট শতাংশের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাম।
৪) শূন্য এ হাতে, কংগ্রেস:
কংগ্রেসের ক্ষেত্রে যন্ত্রনাটা আরও বেশি। কারণ তারাও শূন্যে, তবে ইতিহাসে এই প্রথম সাবেক কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় শূন্য। পুরভোটে সন্তোষ পাঠক গড় রক্ষা করেছেন, কিন্তু তাতে কী রাজ্যে দাঁত ফুটাতে কংগ্রেস ব্যর্থ।
৫) স্ট্যাম্প পড়েনি খামে:
ধর্মের কারবারিরা রাজনীতির ময়দানে এলে তা সুখকর হয় না। ভারতীয়দের অভিজ্ঞতা তাই বলে। তাই ভাইজানের ভাগ্যে গিয়েছে একটি মাত্র আসন। বাম-কংগ্রেসের শিবরাত্রির সলতে হয়ে জ্বলছে ভাঙড়। বাংলার মানুষ খামে স্ট্যাম্প দিতেই ভুলে গিয়েছেন।
৬) সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় আন্দোলন:
স্বাধীনতা পরবর্তী পর্বে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন, এই একুশেই সফল হয়েছে। অন্নদাতাদের অনড় লড়াইয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি সরকার। পিছু হটে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
৭) দলে থেকে কাজ করতে পারছি না:
‘দলে থেকে কাজ করতে পারছি না’ আর ‘বেসুরো’; এই একটি বাক্য আর একটি শব্দ একুশের বাংলার রাজনীতির প্রথম দফায় হার্টথ্রব হয়ে গিয়েছিল। শহর জুড়ে যেন বদলের মরশুম। কেমন করে যেন দলবদলের রাজনীতি বাংলার সংস্কৃতি হয়ে গেল। ফেসবুক পোস্ট করে, হোয়াটস্যাপ গ্রুপ লেফট করলেই আজকাল দল ছাড়া যাচ্ছে। কত সহজ হয়ে গিয়েছে আদর্শর কারবার। বাংলার মানুষ এই সুবিধাবাদী রাজনীতি দিব্যি দেখলেন একুশ জুড়ে। গতি কমলেও গোটা একুশ জুড়ে দল বদল চলেছে। দলের নেওয়া, দলে যাওয়া নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নানা আসন্তোষ চোখে পড়েছে। নেতা দল বদলালে মানুষ যে আবেগ দিয়ে লড়ে তাও দেখল বাংলা।
৮) দিদি ও দিদি বনাম বাংলার মেয়ে:
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন সকলের দিদি, অর্থাৎ তিনি সকলের বাড়ির মেয়ে। তাই মেয়েকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলা। বিজেপির নেতারা যত ব্যক্তি আক্রমণ, কুৎসা বাড়িয়েছে তত সুসংবদ্ধ হয়েছে বিজেপি বিরোধী ভোট। দেশের প্রধামন্ত্রীর দিদি ও দিদি করে কটাক্ষ করেছেন, বাংলার মানুষ কিন্তু বাংলার মেয়ের পক্ষে রায়দান সবাই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে নারী ক্ষমতায় হয়েছে রাজ্যে, মহিলাদের উন্নতির মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন করেছেন মমতা। কন্যাশ্রী থেকে স্বাস্থ্যসাথী সবেতেই বাংলার মহিলারা অগ্রাধিকার পেয়েছেন। তাই মহিলরাও বিপুল জনসমর্থন জানিয়েছে তাদের ঘরের মেয়ের প্রতি, তৃণমূলের এই জয়ের নেপথ্য হাতিয়ার মহিলা ভোট।
৯) নো ভোট টু বিজেপি:
বিজেপির বিরুদ্ধে নেমে পড়ে বাংলার শিক্ষিত সংস্কৃতিপ্রেমী নাগরিকেরা, সুশীল সমাজ পথ নামলে যেকোন শক্তি ধরশায়ী হতে বাধ্য। একুশের নির্বাচনেও তাই হয়েছিল। বিদ্বেষ, বিভেদকামী বিজেপি যে কতটা ক্ষতিকারক তা মানুষের সামনে তুলে ধরে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলন। নির্বাচনের ফলেও প্রতিফলিত হয়েছে এই প্রচারের সুফল। দ্বিমুখী লড়াইয়ে বিজেপিকে দুরমুশ করে বাংলার মসনদে বসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১০) বাঙালি জাতীয়তাবাদ:
কথায় বলে হকের আদায়। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নয়, ধনী দরিদ্রের বিভাজন নয়। একুশে বাংলা ভাষা, মাতৃভাষাই ঐক্য বদ্ধ করে বাঙালিদের। নিজেদের দাবি আদায় করতে বদ্ধ পরিকর হয়ে বাঙালিরা, বাঙালি অস্মিতা রাজ্য রাজনীতির অ্যাজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দি মনোভাবাপন্ন বিজেপি ও তাদের নেতাদের সঙ্গে খাপ খায় না বাঙালির। সাংস্কৃতিক, সামাজিক পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে। বিজেপি যে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্যের পরিপন্থী তাও নিজেরাই নিজেদের আচরণে স্পষ্ট করে দেয়। এখানেই প্রতিষ্ঠা পায় বহিরাগততত্ত্ব। যার সুফল পায় তৃণমূল।
রাজ্য রাজনীতির হাল আমলের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বছরকে চারটি ভাগে ভাগ করলে, প্রথম ভাগটি গিয়েছে সকলের ভাগ্যে। কারণ ধারে-ভারে-লেকচারে সকলেই সমান ছিলেন। কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যেই তলে তলে আসল কাজটি করে গিয়েছিল তৃণমূল, তাই শেষ তিনটি ভাগ একছত্রভাবে জিতে নিয়েছে তারাই। বলাই যায়, একুশ মানেই তৃণমূল।