অ্যাপ তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় মেকি জনমত তৈরি করছে বিজেপি
একদিকে পেগাসাস আর নতুন আমদানি টেক ফগ, অলিখিতভাবে গোটা দেশটাই এখন বিজেপির করাল গ্রাসে। দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। অ্যাপ বানিয়ে দেশবাসীর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয় জনতা পার্টি। অ্যাপের মাধ্যমেই সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড নিয়ন্ত্রণ করে বিজেপি, নিজেদের অনুকূলে জনমত তৈরি করে। এক বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে এল। দেশবাসীর ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরে আঘাত আনছে বিজেপি।
আই টি সেল, ভারতীয় রাজনীতিতে হাল আমলে উদয় হওয়া একটি শব্দ, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসার প্রাক মুহূর্ত থেকেই আমদানি হয়েছিল আই টি সেলের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণা থেকে মিথ্যাচার ছাড়ানো, এই সব কাজ বিজেপি তার আই টি সেলের মাধ্যমে করে এবং বিজেপির আই টি সেলের কর্মীরা বিজেপির বানানো ওই অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করেন।
সম্প্রতি টেক ফগ (Tek Fog) নামের ওই অ্যাপ্লিকেশনটির নাম প্রকাশ্যে এসেছে। এর মাধ্যমেই টুইটারে দলীয় পোস্ট ট্রেন্ডিং করানো থেকে শুরু করে ভুয়ো ভিডিও, ছবি ভাইরাল করা সব করে বিজেপি। রাজনৈতিকভাবে মেকি জনপ্রিয়তা পেতেও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে এই অ্যাপটিকে ব্যবহার করেছে বিজেপি।
আরতি শর্মা নামের জনৈকা এক মহিলার টুইটার হ্যান্ডেল থেকে এই অ্যাপ্লিকেশনের বিষয়ে পোস্ট দেখা গিয়েছে। ওই টুইটার অ্যাকাউণ্ট থেকে ২০২০ সালের ২৪শে এপ্রিলে করা একটি টুইটে নিজেকে বিজেপির আই টি সেল কর্মী বলে দাবি করে ওই মহিলা লেখেন, “আমি ২০১৪ সাল থেকে বিজেপির আই টি সেলের হয়ে কাজ করছি। আমি কাজ ছাড়ছি, কারণ আমাদের বোকা বানানো হয়েছে। আমাদের প্রতি টুইটে ২ টাকা করে দেওয়া হত। কিন্তু ২০১৮ সালে আমাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ২০১৯এ বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে আমাদের চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু এখন বিজেপি তা অস্বীকার করছে। মিথ্যেবাদী বিজেপি! চাকরি কোথায়?”
পরে ২০২০ সালের ২৮শে এপ্রিল ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ফের এক টুইট করা হয়। যাতে লেখা হয়, ” টেক্সট অটো উপলোড করার জন্য বা দলীয় হ্যাসট্যাগ ট্রেন্ড করানোর জন্য বিজেপির আইটি সেল কর্মীদের দ্যি টেক ফগ অ্যাপ ব্যবহার করতে বলছি। এটা গোপনীয় অ্যাপ, এখানে ক্যাপচা কোড লাগে না।” সেই সঙ্গে আরও লেখা হয় বিজেপির আইটি কর্মীরা টাস্কার অ্যাপ ব্যবহার করেন।
বলাইবাহুল্য বিজেপির ওই মহিলা আইটি সেল কর্মী তার সহকর্মী গোপনীয় একটি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। যেখানে ক্যাপচা কোডের প্রয়োজন পড়ে না অর্থাৎ কোন ভেরিফিকেশনের দরকার হয়না। বিভিন্ন মানুষের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো অতিসহজেই হ্যাক করা যায়। তাদের পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করা যায়, নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই এই অ্যাপ্লিকেশন বিজেপি ব্যবহার করে।
আজকের রাজনীতির অনেকটা বড়ো অংশ জুড়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার, নিজেদের দলের প্রচারকে ইচ্ছে মতো বাড়িয়ে নিতে সম্পূর্ণ অনৈতিক ভাবে ওই টেক ফগ অ্যাপটিকে হাতিরায় করছে বিজেপি। মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, সাধারণ মানুষের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করে অলিখিত জরুরি অবস্থা চালাচ্ছে বিজেপি। নিজেদের দলকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় প্রমান করার তাগিদে মানুষের ব্যক্তি জীবনেও উঁকি দিচ্ছে তারা।
জানতেও পারবেন না আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে বিজেপির টুইট রিটুইট হয়ে যাবে, এমনই জাল বুনেছে। কেবল নিয়ন্ত্রণ বা মেকি জনসমর্থন আদায়ই নয়, বিরুদ্ধ মত পোষণকারীদের নাজেহাল করতেও এই অ্যাপ ব্যবহার করছে বিজেপি। টেক ফগ-এর সুবাদে বিজেপির সমালোচনাকারীদের নানান ভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। এই টেক ফগ-এর কান্ডকারখানার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে বিজেপির যুব মোর্চা।
নির্দিষ্ট কিছু সূত্র থেকে প্রমাণ মিলেছে, বিজেপির প্রাক্তন আইটি ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রধান তথা বর্তমানে মহারাষ্ট্র বিজেপির ইলেকশান ম্যানেজার দেবাং দেব, সরাসরি টেক ফগ কান্ডে যুক্ত রয়েছেন।
অনুসন্ধানকারী বেসরকারী সাংবাদমাধ্যমকে, ওই অ্যাপের ব্যবহারকারী নানা স্ক্রিন শট পাঠিয়েছেন, যার মাধ্যেম অ্যাপ্লিকেশনটির কার্জকারিতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা মিলেছে। তাকে এই কাজের জন্য বিজেপি তরফে বেতন দেওয়া হয়, তার পে স্লিপও পাওয়া গিয়েছে। ওই ব্যবহারকারীর ব্যাংকের তথ্য থেকে সে প্রমানও মিলেছে।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক টেক ফগ-এর মাধ্যমে কী কী করে বিজেপি:
১) সোশ্যাল মিডিয়া মেকি জনসমর্থনের প্রদর্শন:
ফেসবুক- টুইটারে ট্রেন্ড সৃষ্টি করার জন্যে, বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে অটো -শেয়ার, অটো রিটুইট করা। মুহূর্তের মধ্যে রিটুইটের পরিমান কৃত্রিমভাবে কয়েক গুন বাড়িয়ে দেওয়া।
২) ফিশিং অ্যাটাক:
বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় হোয়াটস্যাপ অ্যাকাউন্টগুলোকে ব্যবহার করা, ফাঁদে ফেলে তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়। জালে মাছ ধরার মতোই টোপ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি করা হয়। তারপর ওই হোয়াটস্যাপ অ্যাকাউন্টে থাকা সমস্ত নম্বর পেয়ে যায় টেক ফগ ব্যবহারকারী।
৩) নাগরিকের নাজেহাল করা:
ব্যক্তিগত পোস্টকে নজরে রাখা হয়। নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করে, তাদের ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গ, বয়স, রাজনৈতিক আদর্শ ইত্যাদির ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। এমনকি তাদের তথ্য গুগল সিট তৈরি করে নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়।
এই অ্যাপের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হল, এর মাধ্যমে যাবতীয় জিনিস পত্র নিমেষের মধ্যে ডিলিট করা যায়। টেক ফগ ব্যবহারকারী মুহূর্তের মধ্যে সব মুছে দিতে পারবেন। বিজেপির ওই আইটি সেল কর্মী আরতি শর্মার ইউজার আইডি এক মুহূর্তেই বদলে গিয়েছিল।
টেক ফগ ব্যবহারকারী বিজেপির ওই আইটি সেল কর্মীর পে স্লিপের মাধ্যমে দুই কোম্পানীর নাম প্রকাশ্যে এসেছে, তারা হল প্রেসিস্টেন্ট সিস্টেম এবং শেয়ারচ্যাট। এই শেয়ারচ্যাটের মাধ্যমেই বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষায় ট্রেন্ডিং, ভুয়ো খবর ছড়ানো কাজ করে। শেয়ারচ্যাটের সঙ্গে টেক ফগ সরাসরি যুক্ত, এবং বিজেপির যুব মোর্চা এই গোটা কাজটি পরিচালনা করে। যদিও বিজেপির যুব মোর্চা এই অভিযোগ স্বীকার করেছে। ২০১৭-এর উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের সময়তেই শেয়ারচ্যাট বিজেপির রাজনৈতিক কাজ করেছিল।
শেয়ার চ্যাট ছাড়াও গুগল ডক, জোহো, গুগল সিট, টাস্কার, জ্যাপিয়ার, গ্রাফানা, গুগল অ্যানালিটিক্স থেকে টেক ফগ নাগরিকদের তথ্য চুরি করে। টেক ফগ-এর মাধ্যমে মেকি হাওয়া তৈরি করে, বিজেপি সরকার ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন হিন্দি ইংরেজি সংবাদমাধ্যম, রিপালকি ইন্ডিয়া, দৈনিক জাগরন, বিজেপির অনুকূলে জনমত গড়তে সাহায্য করে।
নাগরিকত্ব বিল বিরোধী আন্দোলন, দিল্লির সম্প্রদায়িক দাঙ্গা, করোনা অতিমারি ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় রাজনৈতিক ঘটনায় বিজেপি টেক ফগ অ্যাপের মাধ্যমেই জনমত নিয়ন্ত্রণ করেছিল।