জেসিকা লাল হত্যাকারী মনু শর্মার মুক্তি: কী কী ঘটেছিল এই মামলায়?
জেসিকা লাল হত্যাকাণ্ডের অপরাধী মনু শর্মাকে মেয়াদের তিহার জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দিলেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর অনিল বাইজল। ১৯৯৯ সালে নয়া দিল্লির এক রেস্তোরাঁয় মডেল জেসিকা লালকে খুন করেছিল মনু শর্মা।
জেলের করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কায় যাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তার আওতাতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মনু শর্মাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
জানা গিয়েছে, দিল্লি সরকারের শাস্তি পর্যালোচনা বোর্ড মনু শর্মার মেয়াদের আগে মুক্তির সিদ্ধান্ত নেয় গত ১১ মে। ২০১৭ সাল থেকে বারবার মনুর মামলা পর্যালোচনা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
এই বোর্ডের সভাপতি দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন ডিরেক্টর জেনারেল (কারা), মুখ্যসচিব (স্বরাষ্ট্র), মুখ্যসচিব (আইন শৃঙ্খলা), জয়েন্ট কমিশনার অফ পুলিশ (অপরাধ), সরকারের মুখ্য প্রবেশন অফিসার এবং একজন জেলা বিচারক।
কোনও অপরাধী ১৪ বছর জেল খাটার পরেই কেবলমাত্র তার শাস্তি কমানোর বিষয়টি বিচার্য। বোর্ড বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখে, যার মধ্যে রয়েছে জেলে বন্দি হিসেবে তার আচরণ, যে অপরাধ সে করেছিল তা মুহূর্তের ঘটনা কিনা, অপরাধের প্রকৃতি ও ভয়াবহতা, অপরাধ প্রবণতা ও মুক্তির পর পুনর্বাসনের সম্ভাবনা, প্রভৃতি।
জেসিকা লাল মামলা
১৯৯৯ সালের ২৯ এপ্রিল গভীর রাতে সিদ্ধার্থ বশিষ্ঠ ওরফে মনু শর্মা ৩৪ বছর বয়সী মডেল জেসিকা লালকে গুলি করে খুন করে। মনু শর্মার বাবা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও হরিয়ানা কংগ্রেসের নেতা বিনোদ শর্মা। দক্ষিণ দিল্লির মেহরৌলিতে সোশালাইট বীণা রামানির রেস্তোরাঁ টামারিন্ড কোর্টে জেসিকা লালকে মনুর খুন করার কারণ ছিল, জেসিকা তাঁকে মদ পরিবেশন করতে অস্বীকার করেছিলেন। জেসিকাকে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
১৯৯৯ সালের মে মাসে দিল্লি পুলিশ উত্তর প্রদেশের নয়ডা থেকে একটি টাটা সাফারি উদ্ধার করে। কয়েকদিন পর মনু শর্মা চণ্ডীগড়ের এক আদালতে আত্মসমর্পণ করে, একই সঙ্গে আত্মসমপর্মণ করে এই ঘটনায় যুক্ত আরও ১০ জন, যাদের মধ্যে ছিল উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক নেতা বিকাশ যাদবের ছেলেও।
ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় চার্জশিট ফাইল হওয়ার পর একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এই মামলা বিচারের জন্য সেশনস কোর্টে পাঠায়। সেশনস কোর্ট ৯ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে, কেবল অজিত ঝিঙ্গনকে মুক্তি দেয়।
২০০১ সালের মে মাসে অভিযোগকারী পক্ষের বেশ কিছু সাক্ষী বয়ান বদল করে। কিন্তু সে বছরেরই জুলাই মাসে মালিনী রামানু, বীণা রামানি, জর্জ মেলহট, এবং সুরিন্দর শর্মা আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে মনুকে শনাক্ত করেন।
২০০৬ সালে নিম্ন আদালত মনুকে মুক্তি দেয় এবং তারপর সাার দেশ জুড়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর পর দিল্লি হাইকোর্ট ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের মাধ্যমে নিজেদের হাতে মামলা তুলে নেয়, এবং মনুর খুনের সাজা হয়। এই হত্যকাণ্ডের ঘটনায় মনু, বিকাশ যাদব এবং অমরদীপ সিং গিলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং অলোক খান্না, বিকাশ গিল, হরবিন্দর সিং চোপরা, রাজা চোপরা, শ্যামসুন্দর সিং ও যোগরাজ সিংকে মুক্তি দেওয়া হয়। মনু শর্মার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এবং একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, এবং অমরিন্দর ও বিকাশের চার বছরের কারাদণ্ড ও ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা হয়।
মেয়ের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জেসিকা লালের মা মে লাল ২০০০ সালে মারা যান। জেসিকার বাবা অজিত কুমার লাল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা চলাকালীন ২০০৬ সালে মারা যান। মনু শর্মা দুবার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে শীর্ষ আদালত মনুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি বহাল রাখে। জেসিকা হত্যা মামলায় অভিযোগকারী পক্ষের মূল সাক্ষী শায়ান মুন্সি বিচার চলাকালীন শপথ নিয়ে সেশনস কোর্টে মিথ্যা বলার দায়ে অভিযুক্ত হন।
সায়ান মুন্সিকে দিল্লি হাইকোর্ট ২০১৪ সালে জামিন দেয় এবং তাঁর উপর বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে, এর মধ্যে ছিল তাঁকে নিয়মিত শুনানিতে হাজিরা দিতে হবে, তিনি কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণের ক্ষতির চেষ্টা করবেন না, এবং দেশ ছাড়ার আগে তাঁকে আদালতে তা জানাতে হবে।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে জেসিকা লালের বোন সাবরিনা লাল বলেন যে তিনি মনু শর্মাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তিহার জেল থেকে তাঁকে ছাড়া হলে তিনি আপত্তি করবেন না। তিহাল জেলের ওয়েলফেয়ার অফিসারকে লেখা এক চিঠিতে তিনি জানান তাঁর বোনের হত্যাকারী সিদ্ধার্থ বশিষ্ঠ ওরফে মনু শর্মা ১৫ বছর জেলে কাটিয়েছে, এবার তাকে মুক্তি দেওয়া হলে তাঁর আপত্তি নেই।