বিনোদন বিভাগে ফিরে যান

সৌমিত্রকে দিয়ে সুকুমারকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন সত্যজিৎ

January 19, 2022 | 4 min read

সৌভিক রাজ

সুকুমার এক বিস্ময়ী মানুষ। যা কিছু আপাতভাবে উদ্ভট, আজগুবি তা দিয়েই তিনি নিজের ক্ষনিকের জীবনে বিস্ময় সৃষ্টি করে গিয়েছেন। ছোটদের জন্য রায়চৌধুরীদের অবদান অনস্বীকার্য। সুকুমারও পরিবারের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে গড়েছিলেন নন-সেন্স ক্লাব। বের করতেন ক্লাবের মুখপত্র সাড়ে বত্রিশ ভাজা, সন্দেশের জন্যই তাঁর লিখতে আসা। ভাগ্যিস এসেছিলেন নয়ত কত মনি-মানিক্য হারাত বিশ্ব সাহিত্য!
জিনিয়াস সিনিয়ার রে ছোটদের আনন্দ দিতেই লিখেছেন। সময়টা ছিল ১৯২১ সাল। ছোট্ট মানুষদের জন্য লিখলেন এক যুগান্তকারী গদ্য, ননসেন্স স্টোরি। তবে একে রূপকাশ্রয়ী রচনাই বলা ভাল। কারণ উদ্ভটের আড়ালে লুকিয়ে ছিল আসল সমাজচিত্র। আদপে সমাজ ব্যবস্থাকে বিঁধিয়ে শ্লেষাত্মক এই লেখা হল ‘হ য ব র ল’। শতবর্ষ অতিক্রম করে ফেলেছে হ য ব র ল।

খুব অল্প বয়সেই সত্যজিৎ তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন, সুকুমারের কাজই সত্যজিৎকে তাঁর বাবা পরশের অনুভূতি জুগিয়েছে। হ য ব র ল-ই স্বর্গত বাবার সঙ্গে সত্যজিতের একাধিকার মিলন ঘটিয়েছে। ছাত্রাবস্থায় শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন কলাভবন থেকে ১৯৪২-এ কাকেশ্বরকে নিয়ে নাটক নামিয়েছিলেন সত্যিজিৎ, ১৯৭১-এ আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকীতে হিজিবিজবিজেকে নিয়ে এক কল্পবিজ্ঞানাশ্রয়ী কাহিনী লিখেছিলেন। ১৯৮১ সুকুমার রায়ের জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ বানালেন একটি তথ্যচিত্র, নাম সুকুমার। এখানেও চলে এল হ য ব র ল। সিলুয়েটে কাগজ কেটে সত্যজিৎ বানালেন গাছ আর তার উপরে কাক্কেশ্বর কুচকুচে। এইভাবেই বাবা-ছেলের মাঝে সেতু হয়ে বারবার, হ য ব র ল এসেছে।


নিছক প্রয়োজনেই সন্দেশের পাতা ভরানোর তাগিদে কলম তুলে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ। বাংলার সাহিত্যের অন্যতম দাদা ফেলুর আবির্ভাব হল তার পরে। সন্দেশের পাতায় ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গল্প দিয়ে ফেলু আর তার স্যাটালাইট তোপসে যাত্রা শুরু করল।

এবার বইয়ের পাতা থেকে পর্দায় আসবেন ফেলু, ছবির পালা। অতএব ডাক পড়ল ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের, আদালত থেকে এলেন জটায়ু সন্তোষ দত্ত। পাঠভবন থেকে পেলেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়কে, সে তোপসে হল। ছবি হল সোনার কেল্লা। সত্যজিৎ নিজে জীবৎকালে দুটি ফেলু ছবি বানিয়েছিলেন। দুটিতেই ফেলু ভূমিকায় মাত করেছেন সৌমিত্র। চোখের অভিব্যক্তি মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের, বাংলা চলচ্চিত্রে বৌদ্ধিক অভিনয় মানেই তো সৌমিত্র।

মুকুলকে নিয়ে গুপ্তধনের উদ্দেশ্যে ঘুরছে নকল ডাক্তার হাজরা, আর মন্দার বোস। তাদের ধরতে বালি আর কেল্লার শহরে হানা দিল ফেলু আর তোপসে। জটায়ুর সাথে সেই গল্পেই প্রথম দেখা। ট্রেনে বসতে না বসতেই, সেই বিখ্যাত দৃশ্য। উল্টো দিকে সৌমিত্র। প্রাথমিক আলাপ পর্ব শেষ। জটায়ু ফেলুদার শরীরের মাপ জানচ্ছেন। জটায়ুর গল্পের হিরো প্রখর রুদ্রের সঙ্গে ফেলুদার দেহের গঠন মিলবে কিনা তার হদিশ করতেই; প্রখর রুদ্রের শরীরের মাপ বলতে শুরু করলেন জটায়ু, ‘উচ্চতায় ছ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি। ছাতি ছেচল্লিশ ইঞ্চি কোমর বত্রিশ, কাঁধ বাইশ, কব্জি সাড়ে আট’। গড়গড় করে বলেই জটায়ু ফেলুদাকে জিগ্যেস করেন, ‘মিলছে?’ ফেলুদা সৌমিত্রর উত্তর, ‘না’। খানিক হতাশ হয়ে জটায়ু জানতে চান, ‘আপনার ছাতি কত?’, ‘ছাব্বিশ ইঞ্চি’। জটায়ু আবার জানতে চান, ‘কোমর?’ ফেলুদা বললেন, ‘ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি।’ এবারে হাসতে হাসতে জটায়ু তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলেন, ‘আপনি কি শুয়োর?’ এই অসাধারণ দৃশ্যটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে কাল্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আদপে এ তো সুকুমারের লেখা হ-য-ব-র-ল-র অংশ।

হ-য-ব-র-ল-র সেই দেড়-হাত-লম্বা সবুজ দাড়িওয়ালা বুড়ো উধোর তার পকেট থেকে একটা পুরোনো দর্জির ফিতে বের করে তা দিয়ে গল্পকথককে মাপতে মাপতে কাক্কেশ্বর কুচকুচেকে লিখে নিতে বলেছিল। মনে পড়ে? উধো বলেন, ‘খাড়াই ছাব্বিশ ইঞ্চি, হাতা ছাব্বিশ ইঞ্চি, আস্তিন ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলা ছাব্বিশ ইঞ্চি।’ কথক-আমি সেই হিসেব শুনে বলেছিল, ‘এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি শুয়োর?’ ফেলু কাহিনীতে সুকুমারের ছাপ পেলেন পাঠক দর্শক কূল। সোনার কেল্লার এ সংলাপই হয়ত সুকুমারের প্রতি সত্যজিতের শ্রদ্ধা ছিল।

এরপরের ছবি জয় বাবা ফেলুনাথ। গণেশ মূর্তি উদ্ধার করতে হবে। কাশীর কানা গলিতে গভীর রাত, ভ্যাম্পায়ারের শঙ্কায় বুক কাঁপছে জটায়ুর। রাতের বেনারসের রাস্তায় পান কিনে ফিরছেন ফেলু অ্যান্ড কো! বেনারসের গলিতে রাত্রে হাঁটতে হাঁটতে ফেলুদা সৌমিত্র প্রথমে বলে ওঠেন, ‘অলিগলি চলি রাম, ফুটপাথে ধুমধাম, কালি দিয়ে চুমকাম’। বরাবরের ভীতু জটায়ু বলেন, চারপাশ এত নিস্তব্ধ যে একটু ধুমধাম হলে মন্দ হত না মশাই। জটায়ুর কথায় গলির প্রতিটি বাড়িই হন্টেড, ফলে এখান-ওখান থেকে দু-একটা বাদুড় বেরিয়ে এলেও তিনি আশ্চর্য হব না! জটায়ুর মুখ দিয়ে বাদুড় শুনিয়েই ফেলুদা সৌমিত্রকে দিয়ে হ য ব র ল বলালেন মানিক বাবু। কাশীর গলিতে কানা রাতে সৌমিত্র বলছেন, ‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু, আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু, আজকে হেথায় চামচিকে আর প্যাঁচারা, আসবে সবাই মরবে ইঁদুর বেচারা।’ এ তো সুকুমার! চমকে ওঠেন সুকুমারের পাঠকেরা।

এরপরই ছড়া আর গল্প মিলে যায়। ঘোষালবাড়ির মৃৎশিল্পী নিরীহ নির্দোষ ক্ষীণকায় শশীবাবু মগনলাল মেঘরাজের ছুরির আঘাতে নিহত হলেন। ইঁদুর বেচারা মরল। ছোটদের ছড়ায় মিশে গেল খুন রহস্য!

আবার এই ছবিতেই, গণেশ চুরির রহস্যের কিনারা করতে নাজেহাল সৌমিত্র। মগজাস্ত্রে শান দিতে দিতে আপন মনে সৌমিত্র বলে উঠলেন, ‘তিনটে ব্যাপারে খটকা লাগছে, আফ্রিকার রাজা, শশীবাবুর সিং আর আখতারির গান!’ স্বভাবসিদ্ধভঙ্গিতে জটায়ুর প্রতিক্রিয়া, ‘বোঝো, চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা!’ এ তো ফের হ য ব র ল। এটাই তো সেই বেড়াল বলেছিল, ‘হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে– চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা– হল চশমা! কেমন হল তো?’

বাঙালির দুই গোয়েন্দা, একজন প্রাপ্তমনস্কদের আরেকজন সকলের। দ্বিতীয় জন অর্থ্যাৎ ফেলু আমাদের ঘরের লোক। সে আমাদের সবার দাদা, প্রিয়জন। বইয়ের পাতার সেই প্রিয় দাদাটিকে রক্ত মাংসের অবয়ব দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপরে অনেকেই ফেলুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। আগামীতেও করবেন কিন্তু তুলনায় বারেবারে চলে আসবেন সৌমিত্র। কারণ নতুন ফেলুর অভিনয়ে আমরা সব সময় সৌমিত্রসুলভ অভিনয় খুঁজব। আট থেকে আশির ফেলুদা তিনি। বাঙালির চোখ চারমিনার আর কোল্ট পয়েন্ট থ্রি টু হাতে তাঁকেই খুঁজবে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Soumitra Chatterjee, #feluda

আরো দেখুন