চলে গেলেন ভোম্বল দা, দ্রোনাচার্যহীন ময়দান
সৌভিক রাজ
২২-এর অভিশপ্ত জানুয়ারী ফের একবার আঁচড় কাটলো বাংলার বুকে, এবার ময়দানের পালা। সাইডলাইনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দ্রোনাচার্যকে হারাল কলকাতার ময়দান। থেমে গেল বুলডোজার। আজ শেষ রাতে সাড়ে তিনটে নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি সুভাষ ভৌমিক।
নিজের ফুটবল-জীবনে, খেলোয়াড় এবং কোচ দুই রূপেই অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছেন তিনি। দুর্বার গতিতে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেদ করে এগিয়ে গিয়েছেন তরুণ সুভাষ। সত্তরের দশকে তাঁর পায়ের জোরে কেঁপে উঠত তিনকাঠি, বল জড়িয়ে যেত জালে। তাই কলকাতা ময়দান ভালবেসে তাঁর নাম দিয়েছিল ‘বুলডোজার’। এক যুগ ময়দানে রাজত্ব করেছেন সুভাষ।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে উত্তরবঙ্গের মালদহ থেকে কলকাতার সবুজ ঘাসে এসে পড়লেন দামাল ছেলে সুভাষ, দুর্দমণীয় গতিই তার সম্পদ। ১৯৬৯ সালে যোগ দিলেন লাল হলুদ শিবিরে, ১৯৭০-এ গেলেন সবুজ মেরুনে। ১৯৭২ পর্যন্ত মেরিনার্সদের হয়ে খেলে ফের ১৯৭৩-এ যোগ দিলেন ইস্টবেঙ্গলে। এই পর্বে তিন বছর খেলেলেন সেখানে, ১৯৭৬ সালে ফের মোহনবাগান তাঁবুতে। ১৯৭৮ অবধি সবুজ মেরুন জার্সিতে ময়দান কাঁপানোর পর ১৯৭৯ সালে ইস্টবেঙ্গল থেকে অবসর নেন সুভাষ। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন অলরাউন্ড ফরোয়ার্ড, সুযোগের সদব্যবহার, অসীম গতি আ শারীরিক ক্ষমতা, এই তিন অস্ত্র মন্ত্রে কলকাতার মাঠে রাজত্ব করেছেন সুভাষ ভৌমিক। ১১ বছরের ক্লাব কেরিয়ারে কলকাতার দুই যুযুধান প্রধানের জার্সিতে দাঁপিয়ে বেরিয়েছেন ময়দানে।
মোহনবাগানের জার্সিতে মোট ৮২টি গোল করেছিলেন সুভাষ। তার মধ্যে ছিল চারটি হ্যাটট্রিকও ছিল। অন্য দিকে লাল-হলুদ শিবিরের হয়ে পাঁচ বছরে তিনি ৮৩টি গোল করেছিলেন। ১৯৭০ সালে এক মরশুমে ব্যক্তিগতভাবে ২৭টি এবং পরের মরশুমে ১৯৭০ সালে ১১টি গোল করেছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে তাঁর পা থেকে এসেছিল ১৯টি গোল। প্রমান করেছিলেন তিনি ফুরিয়ে যাননি।১৯৭৩-এর কলকাতা লিগ ডার্বি, সুপার লিগ ডার্বি এবং ৭৪-এর শিল্ড ফাইনালের ডার্বি, এই তিন ডার্বিতে লাল হলুদ ব্রিগেডের হয়ে গোল করেছেন তিনি।
ক্লাব কেরিয়ারে ২৭টি ট্রফি জিতেছিলেন পিকের প্রিয় ভোম্বল। মোহনবাগানকে দিয়েছিলেন ১৬টি ট্রফি। তাঁর সময়ে ইস্টবেঙ্গল পেয়েছিল ১১টি ট্রফি। কলকাতা লিগ জিতেছেন পাঁচ বার (১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৮)। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত একটানা ছবার শিল্ড জিতেছেন। আট বার ঘরে তুলেছেন রোভার্স কাপ। এছাড়াও দুবার করে বরদলই ট্রফি, ডিসিএম ট্রফি জয়ী হয়েছেন। এক বার করে ফেডারেশন কাপ, ডুরান্ড কাপ, দার্জিলিং গোল্ড কাপ ও নাগজি ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছেন খেলোয়াড় সুভাষ। ১১ বছরের ক্লাব খেলোয়াড় জীবনে, এক মাত্র একবারই ১৯৭৯ সালে তিনি কোনও ট্রফি তুলতে পারেননি।
বাংলা ও দেশের হয়েও ট্রফি জিতেছেন সুভাষ। একাধিকবার সন্তোষ ট্রফি জয়ী বাংলা দলের সদস্য থেকেছেন। ১৯৭০ সালের এশিয়ান গেমসে জাপানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী ভারতীয় দলের সদস্য ছিলেন কলকাতার ময়দানের ভোম্বল দা। ১৯৭১-এ দেশের জার্সিতে মারডেকা ট্রফিতে ফিলিপিন্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকও করেছিলেন।
এমন সাফল্য খচিত খেলোয়াড় জীবনের পরে বর্ণময় কোচিং কেরিয়ার শুরু করেন ময়দানের দাপুটে ছেলে। ফুটবল জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসেও চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছিলেন সুভাষ। আইএফএ সচিব প্রদ্যুৎ দত্তরের অনুরোধে ১৯৮৬ সালে জর্জ টেলিগ্রাফের কোচ হিসেবে সুভাষের দ্রোনাচার্য জীবনের অভিষেক ঘটে। পরে এই প্রদ্যুৎ বাবুর অনুরোধের বাংলার কোচের দায়িত্বও সামলেছেন। ১৯৯১ সালে প্রথম বড় দল হিসেবে মোহনবাগানের কোচ হন। যে দলে একদিন খেলোয়াড় ছিলেন সেই তাঁবুতেই প্রশিক্ষক সুভাষের পা পড়ল।
তবে প্রশিক্ষক সুভাষের জীবনের সেরা সময় কেটেছে ইস্টবেঙ্গল শিবিরে। প্রথম বারের জন্য ১৯৯৯-২০০০ মরশুমে তিনি লাল হলুদদের গুরু হন। তার পরে ২০০২-০৫ এবং ২০০৮-০৯ মরশুমে সর্বমোট তিন দফা লাল-হলুদের গুরু হওয়ার গুরুদায়িত্ব সামছিলেন। তাঁর সময়তেই ইস্টবেঙ্গলের সোনালী দিন ফেরে। সুভাষ জমানায় ২০০৩ সালে আশিয়ান কাপ জেতে ইস্টবেঙ্গল। ২০০২-০৩ এবং ২০০৩-০৪ মরশুমে পর পর দুবার জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন করেন ইস্টবেঙ্গলকে। ২০০৬ সালে মহমেডান স্পোর্টিং-এ গেলেন গুরু সুভাষ, ২০০৭-০৮ মরশুমে গোয়ার সালগাঁওকরে যোগ দিয়ে বাংলার বাইরে কোচিং শুরু করেন সুভাষ। ২০১০-১১ মরশুমে ফের মোহনবাগানের কোচ হয়েছিলেন। ২০১২-১৩ মরশুমে গোয়ার চার্চিল ব্রাদার্সকে আই লিগ দিয়েছেন এই দ্রোনাচার্য। শেষ বার ২০১৮ সালে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়েছিলেন সুভাষ। কোচ হিসেবেও একের পর এক সাফল্য পেয়েছেন। সুভাষের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কোচ এবং খেলোয়াড় দুই জীবনেই, এমন সাফল্য ক্রীড়াজগতে বড় একটা দেখা যায় না। ফুটবলার জীবনে মাঠ-ময়দানে চষে বেড়াতেন, প্রশিক্ষক হিসেবেও তার ব্যতিক্রম করেননি।
স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন সুভাষ। আপসহীন এক জীবন যাপন করে গিয়েছেন। নিজের ইচ্ছেতে চলতেন তাই চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েও তাকে ক্লাব ছাড়তে হত, ক্লাবকর্তাদের মন জুগিয়ে চলা তার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। প্রশিক্ষক জীবনে নিজে খেলোয়াড়দের এক সূত্রে বেঁধে রাখতেন, এটাই কোচ সুভাষের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। মাঠের ধারে তাকে দেখে মনে হত এগারো জনের সাথে তিনিও যেন মাঠে নামছেন। আবেগ দিয়েই ফুটবলকে দেখতেন। কলকাতার ময়দানের সেই দামাল ছেলে, সেই সফল দ্রোনাচার্য আজ চলে গেলেন। ময়দানের দর্শকদের স্মৃতি হয়ে থাকবেন তিনি, কলকাতা ময়দানের ভোম্বল আজ থেকে ইতিহাসের মানুষ!