সামরিক অস্ত্রের সঙ্গেই পেগাসাস কিনেছিল বিজেপি সরকার! প্রকাশ্যে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য
রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যাক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেও পিছপা হয়না বিজেপি। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে মানবাধিকারের উপরে আসা সবচেয়ে বড় আঘাতের নজির হল পেগাসাস। ব্যাক্তিজীবনে উঁকি মারতে বিজেপি সরকার যা ব্যবহার করেছে।
বিগত বছরের জুলাই মাস থেকেই পেগাসাস কান্ডে উত্তাল গোটা দেশ। আড়িপাতার খবর প্রকাশ্যে আসতেই, দেশের বিরোধী দলগুলো তীব্রভাবে সরব হয়েছে, পেগাসাস বিতর্কে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে বিজেপি সরকার। যদিও বিজেপি সরকার স্পাইওয়ার পেগাসাস কেনার বা ব্যবহার করার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গিয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে দাবি করা হয়, পেগাসাস নিয়ে এনএসও গ্ৰুপের সঙ্গে ভারত সরকারের কোন প্রকার ব্যবসায়িক চুক্তি হয়নি। বিরোধীদের করা দাবি অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সরাসরি পেগাসাসের ক্রেতা হওয়ার অভিযোগকেও নসাৎ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এল এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বৃহৎ পরিসরে সামরিক অস্ত্র কেনার এক চুক্তি করে। সামরিক অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস কেনার জন্য ভারত এবং ইজরায়েলের মধ্য ঐ সময় প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
নিউইয়র্ক টাইমসের দাবি, ঐ চুক্তির মাধ্যমেই বিজেপি সরকার বিতর্কিত স্পাইওয়ার টুল পেগাসাস কেনে। পেগাসাস একটি মিলিটারি গ্রেড সফ্টওয়ার যা এনএসও গ্রুপ নির্মাণ করে থাকে।
পেগাসাস স্পাইওয়ারের মাধ্যেমে ইজরায়েল কিভাবে কূটনৈতিকভাবে বিশ্ব জুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-সহ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ভারতের মতো দেশ ইজরায়েলের থেকে পেগাসাস কিনেছে।
বিশ্বজুড়ে ইজরায়েলের কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার উদ্দেশ্যে এবং এনএসও-র বানিজ্যিক লাভের লক্ষ্যে তৈরি হওয়া হাতিয়ার আজ বিশ্বব্যাপী হাল-আমলের জাতীয়তাবাদী নেতাদের হাতে শক্তিশালী অস্ত্র রূপে পৌঁছেছে। যদিও ইজরায়েল সরকার তরফে দাবি করা হয়, স্পাইওয়ার কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিক্রির পরেও তার দিকে তাদের তরফে নজর রাখা হয়। কিন্তু আদপে কী তাই! ভারতেই তো পেগাসাস স্পাইওয়ারের মাধ্যমে মানবাধিকারে হস্তক্ষেপের চরমসীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সাল থেকে ভারতের বিজেপি সরকার পেগাসাসকে ব্যবহার করছে। ভারত-ইজরায়েলের ২ বিলিয়ান ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তির ভরকেন্দ্রে ছিল পেগাসাস এবং একটি মিসাইল সিস্টেম।
২০১৭ সালের জুলাইতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইজরায়েল সফরে গিয়েছিলেন। মোদীই ইজরায়েল সফরে যাওয়া প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, ভারত-ইজরায়েলের বৈদেশিক সম্পর্কের ভিত্তি হল প্যালেস্টেনিয়ান চুক্তি। মোদীর ইজরায়েল সফরকে আপাতভাবে সৌজন্যমূলক বলে দেখানো হলেও, এর নেপথ্যে অনেক বড় চক্রান্তের জাল বুনছিল বিজেপি। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেটান্যাহুর সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই ইজরায়েলের সঙ্গে সামরিক অস্ত্র কেনার চুক্তি করেন মোদী। সূত্রের দাবি আদপে ঐ চুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল স্পাইওয়ার পেগাসাস। এর কয়েক মাস পরেই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে আসেন। ২০১৯ সালের জুনে ইউনাইটেড নেশানের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলে ইজরায়েলের পক্ষে ভারত ভোট দেয়। ধারাবাহিকভাবে এই ঘটনাগুলোই ভারতের বিজেপি সরকার, ইজরায়েল, এনএসও এবং পেগাসাসের মধ্যে যোগসূত্রের সাক্ষ্য বহন করে।
কিন্তু ইজরায়েল ও ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কিছুই জানা যায় না। ২০১৭ সালের এপ্রিলে কেবল প্রকাশ্যে আসে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সরবরাহ করার জন্য, নতুন দিল্লির তরফে ইজরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ১২,৮৮০ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বিগত বছরে অর্থাৎ ২০২১-এর জুলাইতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাংবাদসংস্থা তরফে দাবি করা হয়, বিশ্ব জুড়ে নানান দেশে পেগাসাস স্পাইওয়ার ব্যবহৃত হয়েছে। দেশের তালিকায় ভারতও রয়েছে। অ্যাম্নেসটি ইন্টারন্যাশনাল সিকুরিটি ল্যাবের ফরেন্সিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা গিয়েছে, ভারতে প্রায় ১০টি পেগাসাস স্পাইওয়ার ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। দেশের বহু বিরোধী নেতা, সাংবাদিক, বিচারপতি, সেনা অধিকারিক প্রমুখেরা পেগাসারের শিকার হয়েছেন।
২০১৯ সালেও এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে অবৈধ্য সফ্টওয়ার ব্যবহার করার অভিযোগ এনে সরব হয়েছিল হোয়াটস্যাপ। হোয়াটস্যাপ সূত্রে নিশ্চিতভাবে দাবি করা হয়েছিল যে, বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হওয়া ভারতীয় সামাজিক আন্দোলনকর্মীদের এবং সাংবাদিকদের ফোনে পেগাসাসের মাধ্যমে আড়ি পাতা হচ্ছে।
গণতন্ত্রের মন্দির, ভারতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বিজেপির বিরুদ্ধে আনা পেগাসাস ব্যবহারের অভিযোগকে মিথ্যে বলে গলা ফাটিয়েছিলেন, নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে যা কার্যত মিথ্যাচারে পর্যবসিত হল। ২০১৭ থেকেই পেগাসাসকে হাতিয়ার করে, অনৈতিকভাবে বিজেপি যে মানুষের ব্যাক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে তাও প্রমানিত হয়ে গেল।