গুলাবো সিতাবো রিভিউ – সুজিতের আয়নায় ফুটে ওঠে সামাজিক অবক্ষয়
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। অমোঘ এই সত্যটা আমরা জেনেও না জানার ভান করি। দেখনদারির এই দুনিয়ায়, দু কড়ি ফেললেই যেখানে কাজ হয়ে যায়, সেখানে সততার স্থান যে দুয়োরানীর, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু জাগতিক বিচারের ওপরেও আছেন একজন ন্যায়াধীশ, ভাগ্যনিয়ন্তা – যার রাজদণ্ডে কোনও ভেদাভেদ হয় না। নিয়তিই হাসে শেষ হাসি। লখনৌ এর মির্জার ক্ষেত্রেও ঘটল তাই।
পরিচালক সুজিত সরকার ও লেখক জুহি চতুর্বেদীর যুগলবন্দিতে নানা স্বাদের অসামান্য ছবি উপহার পেয়েছেন দর্শকরা। লকডাউনের এই বাজারে তাদের নতুন উপস্থাপনা ‘গুলাবো সিতাবো’ আবার নতুন করে এই জুটির প্রেমে পড়তে বাধ্য করে সিনেমানুরাগীদের। এই প্রথম ভারতে কোনও ছবি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সরাসরি মুক্তি পেল, প্রেক্ষাগৃহের আগেই। যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তে জলঘোলা হয়েছে অনেক। কিন্তু এখন সেসব অতীত।
সুজিত-জুহির জুটির সৃষ্ট চরিত্ররা আর পাঁচটা মানুষের মতই। সাধারণ ছাপোষা মানুষের মতই দোষ, ত্রুটি এবং দুর্বলতা আছে। মির্জা (অমিতাভ বচ্চন) যেমন হাঁড়-কিপ্টে, লোভী। স্ত্রীর মৃত্যুতে এক বিরাট অট্যালিকার মালিক হবে সে। তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে মির্জা, কবে জীবনাবসান হবে ফাতিমার। অন্যদিকে আমরা পাই বাঁকে-কে। সাধারণ নিম্নবিত্ত ছেলে। মা ও তিন বোনের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। সে জানেই না তার বোনেরা কে কোন ক্লাসে পড়ে। ছোটবোনকে চাকরিও করতে দিতে চায় না সে, পৌরুষে বাঁধে বলে।
এরকমই নানা চরিত্রের বাস লখনৌয়ের ফাতিমা মহলে। ‘গুলাবো সিতাবো’ আসলে একটু পুতুলখেলা মাত্র, যেখানে দুই যুযুধান চরিত্র একে অপরকে পর্যুদস্ত করতে চায়। তাই তো, মির্জা বাঁকের বাল্ব চুরি করে, বাঁকে সামান্য বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার জন্য করে নানা ভনিতা। তাদের কৃতকর্ম হাসির উদ্রেক করলেও তার পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর হতাশা। হাসি, হতাশা ও সামাজিক অবক্ষয়ের মিশেল এই ছবি যেন আমাদের সামনে তুলে ধরে আয়না।
ছবির মুখ্য দুই ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চন ও আয়ুষ্মান খুরানার অনবদ্য অভিনয় দু’ঘন্টা ধরে আপনাকে আকৃষ্ট করে রাখবে। অনেক সময় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলেও লেখনীর ঠাসবুনোট বাধ্য করবে ধাবমান স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে। পাশাপাশি, ছবির মহিলা চরিত্ররা ছোট পরিসরেও মন জয় করেন। বেগমের চরিত্রে ফারুখ জাফর অনবদ্য। মির্জার সাথে ওনার রসায়ন মুগ্ধ করবে আপনাকে। বাঁকের বোন গুড্ডুও ছাপ রেখে যায় পর্দায়।
কিন্তু ছবির মূল চরিত্র ফাতিমা মহল – সুজিত তার চিত্রগ্রাহক অভীক মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে তুলে ধরেছেন ক্ষয়িষ্ণু এক ইতিহাসকে। সময় এখানে এসে যেন থেমে গেছে। কর্কট রোগাক্রান্ত রুগী যেমন ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে ধাবমান, এই মহলও নুব্জ্যে পড়েছে কালের চক্রে। বিবর্ণ এই মহল মনে করিয়ে দেয় জলসাঘরের কথা। পড়ন্ত জমিদার বিশ্বম্ভর রায় যেমন নিয়তিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফাতিমা মহলের খিলান, ভাঙা গ্রিল, ধুলোমাখা ঘর, বারান্দা, উঠোন, ক্ষয়ে যাওয়া দেওয়ালও যেন মনে প্রাণে শতাব্দী প্রাচীন মর্যাদা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে। পরিচালকের এই প্রয়াসে সঙ্গত দেয় শান্তনু মৈত্রর আবহসংগীত।
ছবির শেষে মন ছটফট করে। ভবিতব্যকে মেনে নিতে মন চায় না। কিন্তু এরই নাম তো জীবন। পথের পাঁচালীতে যেমন বলে গেছেন বিভূতিভূষণ “চরৈবেতি, চরৈবেতি”।
রেটিং: ৩.৫/৫ স্টার