উঠে যেতে পারে সোনাগাছির সমবায় ব্যাঙ্ক ‘উষা’, আতঙ্কিত যৌনকর্মীরা
শুধু সোনাগাছি নয়, কলকাতার অন্য যৌনপল্লিগুলিতেও নতুন করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। চিটফান্ডে ভরসা করে সব খোয়ানো যৌনকর্মীরা নির্ভর করেছিলেন তাঁদের নিজস্ব উষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির উপরে। ওঁরা সবাই যাকে উষা ব্যাঙ্ক বলেই ডাকেন। শুধু কলকাতার বিভিন্ন পাড়া নয়, গোটা রাজ্যের প্রায় ৩৭ হাজার যৌনকর্মী এই ব্যাঙ্কের সদস্য। সেই ব্যাঙ্কই উঠে যাওয়ার ভয় তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। জমিয়ে রাখা টাকা আর না-ও মিলতে পারে বলে যৌনকর্মীদের একাংশের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
ডোমজুড়ের যৌনপল্লি থেকে কলকাতার সোনাগাছি, হাওড়া স্টেশন ছেয়ে গিয়েছে পোস্টারে। সেখানে বলা হয়েছে, যৌনকর্মীদের সমবায় ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা লোপাট হয়ে যেতে পারে। ওই সব পোস্টারে ২০ হাজার যৌনকর্মীর জমানো টাকা বিপদে রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। সুদ-সহ সব টাকা যাতে সকলে ফেরত পান, তা নিশ্চিত করতে সরকারি হস্তক্ষেপেরও দাবি করা হয়েছে। অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও পাল্টা সক্রিয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে এবং ব্যাঙ্ককে বিপদে ফেলার চেষ্টা চলছে বলে তাঁরা ইতিমধ্যেই পুলিশের কাছে নালিশ জানিয়েছেন। রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার কাছে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে উষা সমবায় ব্যাঙ্ক পরিচালনার মূল সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। এই ব্যাপারে শশীর বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হয় সংবাদ মাধ্যমের তরফে। কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব যায়নি।
‘‘একটা সময়ে যৌনকর্মীরা আয়ের টাকা জমাতেন বিছানার তোষকের নীচে। কিন্তু অনেক সময়েই সেই টাকা বিশ্বাস করে বলা বাবুরা হাতিয়ে নিতেন। যৌনপল্লিতে চড়া সুদে টাকা ধার দিত কিস্তিওয়ালা, চটাওয়ালারা। তাদের কাছে মেয়েদের ঠকতে হত। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা সুদের জালে জড়িয়ে যেতে হত। সেই সব দেখেই দুর্বারের প্রতিষ্ঠাতা স্মরজিত জানা সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি করেন,’’— বলছেন দুর্বারের মুখপাত্র মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়। এখনও এই ব্যাঙ্ক যৌনকর্মীদের বড় ভরসার জায়গা বলে দাবি মহাশ্বেতার।
মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে শুরু হয় এই সমবায় ব্যাঙ্ক। উষার কর্মী শতাব্দী সাহা বলেন, ‘‘বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমবায় আইন। ১৯৯৫ সালে যৌনকর্মীরা এই সমবায়টির সরকারি স্বীকৃতির আবেদন করলে প্রথমে নাকচ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে বলা হয়, ১৯৮৩ সালের সমবায় আইন অনুযায়ী, ‘উন্নত চরিত্রের’ অধিকারী না হলে সমবায় গঠন করা যায় না।’’ শতাব্দী আরও জানান, রাজ্যের তৎকালীন সমবায়মন্ত্রী সরল দেবের হস্তক্ষেপে সমবায় আইন থেকেই বাদ যায় ‘উন্নত চরিত্র’ কথাটি। ১৯৯৫-এর ২১ জুন স্বীকৃতি পায় উষা।
এর পর থেকে উষা ক্রমেই এগিয়েছে। ব্যাঙ্কের ফিনান্স ম্যানেজার শান্তনু চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এখন ৩৭ হাজার সদস্য থাকলেও এই সমবায়ের সক্রিয় সদস্য দশ হাজারের মতো। একটা সময়ে বার্ষিক টার্ন ওভার ২৪ কোটি টাকাও হয়েছিল। তবে এখন সেটা কমে বার্ষিক ১৪ কোটি টাকার মতো।’’ শান্তনুর কথায়, ‘‘২০১৬ সালে নোটবন্দির পর থেকেই যৌনকর্মীদের রোজগার কমতে থাকে। তখন থেকেই তার প্রভাব পড়তে থাকে ব্যাঙ্কে। সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতিতে চরম সঙ্কটে পড়েন যৌনকর্মীরা। রোজগার একেবারে শূন্যে পৌঁছে গিয়েছিল একটা সময়। তখন ব্যাঙ্কের জমানো টাকাতেই অনেকের সংসার চলেছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সন্তানদের লেখাপড়া কিংবা জমি, বাড়ি কিনতে অনেকেই টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁদের একাংশ কিস্তির টাকা ঠিক মতো দিতে পারছেন না। ফলে একটু চাপেই রয়েছে ব্যাঙ্ক। তার মধ্যে ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে রটনায় যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তাতে আরও মুশকিল হয়েছে। গ্রাহকদের বড় অংশ টাকা তুলে নিতে চাইছেন। কিন্তু সকলে একসঙ্গে চাইলে সব টাকা তো আর ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। সমবায় ব্যাঙ্কের নিয়ম মেনেই টাকা তুলতে দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনও অনিয়ম নেই।’’
দুর্বারের দাবি, সঙ্কট শুরু হয় ২০২১ সালের মে মাসে স্মরজিতের মৃত্যুর পরে। মহাশ্বেতা বলেন, ‘‘স্মরজিত জানার মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এই সমবায়ের কর্তৃত্ব চেয়েছিলেন। ওঁর মেয়ে সময়িতাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনেও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি কিছু দিন আসার পরেও কারও সঙ্গে বনিবনা হয়নি। এখন আর তিনি আসছেন না, যোগাযোগও রাখছেন না।’’ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সমবায়ের নির্বাচন হয়। শেষ বার হয়েছিল ২০১৫ সালে। করোনার কারণে ২০২১ সালে নির্বাচন হয়নি। ফলে পুরনো কমিটিই কাজ করছে। সময়িতার সঙ্গে দুর্বার ও সমবায় কর্তৃপক্ষের বনিবনা যে হয়নি তা স্বীকার করছেন উষার বিদায়ী সভাপতি ভারতী দে। তিনি বলেন, ‘‘এই সমবায়ের নিয়ম অনুযায়ী ভোটে অংশ নিতে পারেন শুধু যৌনকর্মীরা। তাঁরাই বিভিন্ন পদে থাকা এবং ভোটদানের অধিকারী। ফলে অন্য কেউ চাইলেই উষার দখল নিতে পারেন না। কাউকে বসতেও দেব না। মনে রাখতে হবে, এই সমবায় ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারলেও ভোটদানের অধিকার নেই যৌনকর্মীর সন্তানদেরও।’’ এই প্রসঙ্গে সময়িতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে হলেও তাঁকেও ফোনে পাওয়া যায়নি। ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলতে চাইলে সাড়া দেননি তিনি।
দুর্বার বা উষা কর্তৃপক্ষ যেটা বলছেন তা মানতে রাজি নন সমাজকর্মী দেবপ্রিয় মল্লিক। দীর্ঘ দিন যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা দেবপ্রিয় বলেন, ‘‘উষার লোকেরা যা বলছেন তা ঠিক নয়। যৌনকর্মীদের জমানো টাকা দিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি কেনা হয়েছে। ওখানে যৌনকর্মীদের জমানো টাকার পরিমাণ ১০০ কোটি হবে। সেখানে ব্যাঙ্ক মেটাতে পারবে বড় জোর ২০ কোটি টাকা। এটা আর একটা সারদা হতে চলেছে। আবার পথে বসবেন যৌনকর্মীরা। মনে রাখতে হবে, যাঁরা টাকা রেখেছেন তাঁদের ৯৭ শতাংশই গরিব।’’
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জনস্বার্থ স্বাধীকার মঞ্চ’-এর অন্যতম প্রধান দেবপ্রিয় দীর্ঘদিন স্মরজিতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজও করেছেন। একটা সময়ে দুর্বারের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দেবপ্রিয় আরও বলেন, ‘‘যৌনকর্মীরাই বিপদে পড়ে আমাদের কাছে এসেছেন। তাঁরাই অন্যদের বিপদ থেকে বাঁচাতে পোস্টার মারছেন। আমরা চাই, সরকার এখনই হস্তক্ষেপ করুক। তা না হলে কিছু দিনের মধ্যেই হাজার হাজার যৌনকর্মী চরম বিপদের মুখে পড়বেন।’’
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত কোনও লিখিত অভিযোগ জমা পড়েনি। অভিযোগ পেলেই সমবায় আইন মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
এত বিতর্কের থেকে অনেকটাই দূরে সোনাগাছির অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট বা মসজিদ বাড়ি লেনের শেফালি, শবনমরা। পেট চালানোর তাগিদে সন্ধ্যার সাজ অটুট থাকলেও তার আড়ালেই রয়েছে আর্থিক চিন্তার বিষণ্ণতা। যৌনকর্মীরা বলছেন, উষা অনেক সময়েই তাঁদের বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন উষার বিপদ মানে সেটা তো তাঁদেরও। কিন্তু সত্যিই কি সঙ্কটে তাঁদের নিজেদের ব্যাঙ্ক! না কি সবটাই আতঙ্ক ছড়ানোর অপচেষ্টা! বুঝতেই পারছেন না সোনাগাছির অনেক বাসিন্দা। ভয়ে ভয়ে তাই ব্যাঙ্কে এসে লাইন দিচ্ছেন। জমানো টাকা ঠিকঠাক আছে তো! চিটফান্ডে টাকা রাখার অভিজ্ঞতা এখনও দগদগে। তাই ভয়, ফের সব খোওয়ানোর চোরাস্রোত বইছে না তো!