ইউপিতে লাল টুপি উড়ে গেল গেরুয়া ঝড়ে, এবার কী করবেন অখিলেশ?
প্রথম বার বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। সমর্থকদের স্থির বিশ্বাস ছিল, এ বার লখনউয়ের মুখ্যমন্ত্রী আবাসে ‘বিধায়ক’ হিসেবেই ঢুকবেন অখিলেশ যাদব (কারণ, এর আগে অখিলেশ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলেও ছিলেন বিধান পরিষদের সদস্য)। মুলায়ম-তনয়ের জন্য আসন বেছে নেওয়া হয়েছিল সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-র শক্তঘাঁটি মৈনপুরীর করহল।
বৃহস্পতিবার ইভিএমের গণনা বলছে, নিজের আসনে বিপুল জয় পাচ্ছেন। কিন্তু দল বা জোটকে নিয়ে ২০২-এর গণ্ডি টপকাতে ব্যর্থ মুলায়মপুত্র ‘টিপু’। ২০২ আসন তো দূর অস্ত, এসপি জোটকে থামতে হচ্ছে তার বহু আগেই। যদিও দল হিসেবে আগের বিধানসভা ভোটের তুলনায় ফল ভাল করেছে এসপি।
এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠছে, কী করবেন অখিলেশ? সরকার গড়ার লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধে নেমে তিনি কি বিরোধী দলনেতার ভূমিকায় লখনউয়ের বিধানসভায় ঢুকবেন? না কি পরিষদীয় রাজনীতিকে আপাতত বিদায় জানিয়ে ফিরবেন নিজের সাংসদ সত্তাতেই। উত্তরপ্রদেশের আজমগড় লোকসভা কেন্দ্র থেকে এসপি-র সাংসদ তিনি।
অখিলেশ যে রাস্তাই বেছে নিন, উত্তরপ্রদেশে এই বিধানসভা ভোটের পরেও অন্তত একটি উপনির্বাচন হচ্ছেই। হয় আজমগড়। নয় করহল। তবে যোগী আদিত্যনাথের কাছে ‘কিস্তিমাত’ হলেও অখিলেশের রাজনৈতিক জীবন থেমে থাকবে না। মাত্র আটত্রিশে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এ বার তাঁর লড়াই ছিল এসপি-র অন্দরেও। বাবা মুলায়ম সিংহ যাদবের জায়গায় ‘নেতা’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত করার। আপাতত সে পরীক্ষায় ব্যর্থ ‘টিপু’।
বস্তুত, নিজের পিতৃপরিচয়ে সে ভাবে কখনওই পরিচিত হতে চাননি অখিলেশ। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন পড়ুয়া চোখা নাকের ছেলেটি থাকত ‘পেয়িং গেস্ট’ হিসেবে। আর পাঁচটা ভারতীয় পড়ুয়া যেমন বিদেশ বিভুইয়ে পড়াশোনা সারে, তারও তেমনই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হল আর কই?
শোনা যায়, অমর সিংহ এক বার অস্ট্রেলিয়া গিয়ে হাটে হাঁড়িটি ভেঙেছিলেন। সে দিনের পর থেকে আশেপাশে চাউর হয়ে গিয়েছিল, মুখচোরা চোখা নাক আসলে ভারতের কেউকেটার সন্তান। তিনি অখিলেশ যাদব। উত্তরপ্রদেশের ‘নেতাজি’ মুলায়ম সিংহ যাদবের পুত্র।
সেই অখিলেশের কাছে এ বারের বিধানসভার ভোট ছিল ‘হয় এ বার, নয় নেভারের লড়াই’। এই লড়াই যতটা না তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বের, আরও বেশি পরিবারের মধ্যে নিজের নেতৃত্বদানের যোগ্যতা প্রমাণের। প্রাথমিক ভাবে লখনউয়ের তখ্ত দখলের লড়াইয়ে অখিলেশকে খুব একটা চোখে না পড়়লেও শেষ তিনমাসে কার্যত ঝড় তুলে দিয়েছিলেন উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম। আর জনসভা থেকে রোড শো— লাল টুপির থিকথিকে ভিড় দেখে চোখ কপালে উঠছিল গেরুয়া শিবিরের।
২০১৭-এর বিধানসভা এবং ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি-র যে যে চালে মাত হয়েছিলেন, এ বার আগেভাগেই পাল্টা চাল হিসেবে সেই ছোট দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে রেখেছিলেন অখিলেশ। হাতের ‘এম-ওয়াই’ (মুসলিম ও যাদব সম্প্রদায়) সমীকরণকে অটুট রেখে অ-যাদব পিছিয়ে-পড়াদের সাইকেলে চাপাতে পশ্চিম ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশের কিছু ছোট দলের সঙ্গে গাঁটছড়াও হয়েছিল। আর বিজেপি-র ‘মূল’ অস্ত্র, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফাঁদে পা না দেওয়ার পণ ছিল মাথায়। পাল্টা হিসেবে তুলে এনেছিলেন দেশের বৃহত্তম রাজ্যে ব্যাপক ‘বেরোজগারি’ বা বেকারত্বের করুণ চিত্রকে। বয়স্ক গবাদি পশুর প্রসঙ্গও বারেবারে উঠে এসেছিল মুলায়মপুত্রের গলায়।
এহ বাহ্য, ২০২১-এ নীলবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপি-কে পর্যুদস্ত করে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশে বিরোধীদের অক্সিজেন যুগিয়েছেন, সেই ‘দিদি’কে দু’দফায় উত্তরপ্রদেশ নিয়ে গিয়ে প্রচার করিয়েছেন। প্রথম বার লখনউ থেকে ভার্চুয়াল সভা করলেও দ্বিতীয় বার বারাণসীতে প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা করেছেন মমতা। বাঙালির দ্বিতীয় বাড়ি, কাশীর বিপুল বঙ্গভাষীর কাছে মমতার আবেদন ছিল, ‘‘বদলের স্বার্থে অখিলেশের পাশে দাঁড়ান। বাংলা থেকে বিজেপি তাড়ানোর যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, উত্তরপ্রদেশেও একই ফল করে বিজেপি-কে আরও দুর্বল করুন। যাতে ২০২৪ সালে রামধাক্কা দিয়ে দেশ থেকেই তাড়ানো যায় বিজেপি-কে।’’
সব মিলিয়ে উত্তরপ্রদেশকে বিজেপি-র বদ্ধভূমিতে পরিণত করতে চেষ্টার কসুর করেননি মহিশূরের প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
লোকসভায় লড়েছেন। কিন্তু কখনও বিধানসভা ভোটে লড়েননি। যদিও উত্তরপ্রদেশে একটি পুরো দফার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সে বার অখিলেশ ছিলেন বিধান পরিষদের সদস্য। কিন্তু এ বার তিনি মৈনপুরী লোকসভা কেন্দ্রের করহল বিধানসভা আসন থেকে সরাসরি ভোটযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বিপরীতে বিজেপি-র এসপি সিংহ বাঘেল। বিজেপি বলেছিল, আদিত্যনাথ যে-ই বিধানসভায় লড়ার কথা ঘোষণা করলেন, চাপে পড়ে অখিলেশও ভোটে দাঁড়াতে গেলেন। মৈনপুরী আদতে ‘নেতাজি’ মুলায়মের ‘খাসতালুক’ বলে পরিচিত। সেই প্রসঙ্গ টেনে বিজেপি-র কটাক্ষ ছিল, বাপের ছায়া থেকে এখনও বেরোতে পারেননি টিপু (অখিলেশের ডাকনাম)। আর অখিলেশের তরফ থেকে কেবল বলা হয়েছিল, সব জবাব মিলবে ১০ মার্চ। গণনার ফল বলছে, সব ইচ্ছে পূরণ হয় না।