সামান্য একটা ওষুধেই কমছে করোনায় মৃত্যুহার
আশার আলো! করোনাভাইরাস চিরতরে রুখে দেওয়ার মতো ওষুধের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক। অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য ডেক্সামেথাসোন (Dexamethasone) নামের এই ওষুধটি করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জীবন বাঁচাতে ইতিমধ্যেই সাহায্য করেছে। ওই গবেষকরা জানাচ্ছেন, আগামী দিনে COVID-19 এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে কম ডোজের এই স্টেরয়েড চিকিৎসা সারা বিশ্বকে দিশা দেখাবে। জীবনরক্ষাকারী এই ওষুধ ভেন্টিলেশনে থাকা করোনা রোগীদের মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিতে পারে। আবার অক্সিজেন সাপোর্টে রয়েছেন যে করোনা রোগীরা, তাঁদের মৃত্যুহার এক-পঞ্চমাংশ অবধি কমিয়ে দিতে পারে এই ডেক্সামেথাসোন (Anti-Inflammatory Steroid Dexamethasone)।
এই ওষুধে যে সাফল্য মিলেছে তাতে উচ্ছ্বসিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এ দিন সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি বলেছেন, “ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব উদযাপনের আজ উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। জীবনরক্ষাকারী করোনাভাইরাস ড্রাগ ডেক্সামেথাসোন এখন NHS (United Kingdom National Health Service) জুড়ে উপলব্ধ করা যেতে পারে।” অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকরা আরও বলছেন যে, ঠিক যে সময়ে ব্রিটেনে মারণ এই ভাইরাস ব্যাপক পরিমাণে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছিল, সেই সময়েই এই ওষুধ কমপক্ষে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারত। পাশাপাশিই ওই গবেষকদের আরও দাবি যে, অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলিতেও কাজে আসত সস্তার স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসোন।
কিন্তু কী ভাবে এতটা নিশ্চিত হয়ে বলছেন গবেষকরা? করোনা আক্রান্ত প্রতি ২০ জনের মধ্যে ১৯ জনই স্রেফ এই স্টেরয়েড নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ঠিক এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করলেন ওই বিজ্ঞানীদল। তাঁদের আরও দাবি, হাসপাতালেও করোনা চিকিৎসা চলছে এমন রোগীদেরও দেওয়া হয়েছিল এই ওষুধ। তাঁদের অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন পড়লেও সুস্থ হয়ে উঠেছেন স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসোনের (Dexamethasone) প্রয়োগে।
কী ভাবে করোনা আক্রান্তদের সুস্থ হওয়ার কাজ করছে এই স্টেরয়েড? ডেক্সামেথাসোন মূলত ব্যবহার করা হয়, শরীরের প্রদাহ কমাতে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকদের দাবি, COVID-19 এর সঙ্গে লড়াই করার সময়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন অতিরিক্ত পরিমাণে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে, ঠিক তখনই কাজে আসে এই স্টেরয়েড। এই ধরনের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় সাইটোকাইন স্টর্ম (cytokine storm)। এই সাইটোকাইন স্টর্ম কিছু ক্ষেত্রে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ওষুধটির পরীক্ষা করতে ওই গবেষকরা প্রথমে ২ হাজার করোনা আক্রান্তের উপরে প্রথমে প্রয়োগ করেন। আর তার পরে ৪ হাজার করোনা আক্রান্ত, যাঁদের শরীরে এই স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হয়নি, তাঁদের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করে দেখা হয়।
অক্সফোর্ডের এই বিজ্ঞানীদের দাবি, ভেন্টিলেটরে থাকা রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি এক লহমায় ৪০-২৮ শতাংশ অবধি কমিয়ে দিতে পারে ডেক্সামেথাসোন (Dexamethasone)। এছাড়া যেসব করোনা আক্রান্তের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, তাঁদের মৃত্যুর ঝুঁকি ২৫-২০ শতাংশ কমাতে পারে জীবনরক্ষাকারী এই ওষুধ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষক দলের প্রধান, অধ্যাপক পিটার হরবির কথায়, “এটাই এখনও পর্যন্ত এমন একটা ওষুধ যা করোনা আক্রান্তদের মৃত্যুহার কমিয়ে দিয়েছে। এই ওষুধের সন্ধান আদপে করোনার চিকিৎসায় একটা বড় অগ্রগতি, সে কথা স্বীকার করতেই হয়।”
কত দিন চলে এই স্টেরয়েডেক কোর্স? অক্সফোর্ডেরই আর এক অধ্যাপক মার্টিন ল্যান্ড্রে জানালেন, ভেন্টিলেটরে রয়েছেন এমন ৮ জন রোগীর মধ্যে ১ জনের প্রাণ বাঁচাতে পারে ডেক্সামেথাসোন। পাশাপাশিই অক্সিজেন সাপোর্টে থাকা ২০ থেকে ২৫ জন রোগীর ১ জনের প্রাণরক্ষা করতে সক্ষম এই স্টেরয়েড। তাঁর কথায়, “এই ওষুধ যে মানুষের কাজে আসছে, তা একপ্রকার স্পষ্ট। ডেক্সামেথাসোনের চিকিৎসা ১০দিন পর্যন্ত চালাতে হয়। প্রত্যেক রোগী পিছু খরচ হয় মাত্র ৫ ডলার। মূলত একটি প্রাণ বাঁচাতে ডেক্সামেথাসোনের চিকিৎসা খরচ ৩৫ ডলার। এই ডেক্সামেথাসোনই একমাত্র ওষুধ, যা সারা বিশ্বে সহজলভ্য।”
মার্টিন ল্যান্ড্রে আরও বলেছেন যে, প্রত্যেক হাসাপাতেল যথাযথ সময়ে করোনা আক্রান্তদের এই ওষুধটি দেওয়া উচিত। যদিও বাড়িতে কোনও রোগীর চিকিৎসার জন্য এই ওষুধটি কেনা ঠিক হবে না বলেও সতর্ক করছেন তিনি। এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো যে, COVID-19-এর মৃদু উপসর্গ রয়েছে, এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ডেক্সামেথাসোন কোনও সাহায্য করবে না। যাঁদের নিঃশ্বাস নিতে কোনও রকমের অসুবিধা নেই, তাঁদের ক্ষেত্রেও কাজে আসবে না এই ওষুধ।
গত মার্চ থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মারণ এই ভাইরাস-কে ঠেকানোর জন্য নানাবিধ ওষুধের পরীক্ষা চলছে। এমনকী ম্যালেরিয়া চিকিৎসার জন্য জরুরি ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের (Hydroxychloroquine) পরীক্ষাও চালানো হয়েছে। তবে এই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনে করোনা রোগীদের মৃত্যুহার এবং হার্টের সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে বলে আগেই সতর্ক করেছেন গবেষকরা। এছাড়া অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ রেমডেসিভির (Remdesivir) নিয়েও করোনার চিকিৎসায় পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এই রেমডেসিভির প্রয়োগে করোনা আক্রান্ত রোগীরা খুব কম সময়েই সুস্থ হয়ে উঠছেন প্রমাণ হওয়ায় পরই ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ওষুধটি প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে।
তবে এই প্রথম নয়। COVID-19 রোগীদের মৃত্যুহার কমাতে সাহায্য করছে, এমন ওষুধের খোঁজ আগেও পাওয়া গিয়েছে। যদিও সেগুলোর সবই প্রায় অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে আশাব্যঞ্জক দিকটি হল, অক্সফোর্ড বিজ্ঞানীদের নতুন এই গবেষণার ফল অর্থাৎ স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসোন (Dexamethasone) যেমন সস্তা, তেমনই সহজলভ্য। জেনে রাখা ভালো যে, আজ নয় ১৯৬০ সালের গোড়ার দিক থেকেই বাত, হাঁপানি এবং প্রদাহের চিকিৎসায় ডেক্সামেথাসোন ওষুধটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।