আজ চিপকো দিবস, জেনে নিন চিপকো আন্দোলনের ইতিকথা
সৌভিক রাজ
যুগ যত এগিয়েছে মানুষ নিজের স্বাছন্দের জন্য পরিবেশকে তত নির্বিকারে যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছে। এই প্রসঙ্গে গান্ধীজির একটি কথা মনে পড়ে যায়, “Nature is enough for our need, but it is not enough for our greed” সত্যি লোভের কাছে আমরা হয়ত পরাজিত হই, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ রুখে দাঁড়ান পরিবেশের রক্ষায় এমনি ছিলেন অমৃতা দেবী। তেমনই একজন পরিবেশপ্রেমী ছিলেন সুন্দরলাল বহুগুনা। মানুষ উন্নয়ন আর নগরায়োনের ফলে ক্রমাগত ধ্বংস করে চলে আরণ্য আর পরিবেশের, এমনই এক ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি দশকে যা ইতিহাসে চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত।
সুন্দরলাল বহুগুনার জন্ম হয়েছিল ১৯২৭ সালের ৯ই জানুয়ারী উত্তরপ্রদেশের তেহরি অঞ্চলে, তিনি গাড়োয়াল হিমালয় অঞ্চলে পরিবেশ রক্ষার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন। সুন্দরলাল বাহুগুনাই ছিলেন চিপকো আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। ১৯৮১ সালে এবং ২০০৯ সালে তিনি পরিবেশে রক্ষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের জন্য ভারত সরকারের তরফ থেকে যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ সন্মান পান। তিনি ও তাঁর স্ত্রী বিমলা বহুগুনা মিলিত ভাবেই চিপকো আন্দোলন গড়ে তোলেন।
চিপকো আন্দোলন :
স্বাধীন ভারতে ১৯৭৩ সালে প্রথম পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল অঞ্চল। সরকারের লোকজন এখানে ১০০ গাছ কাটতে উদ্যোগী হয়। উদ্দেশ্য ছিল কারখানা স্থাপন। প্রথম বাধা দিলেন গ্রামেরই দুই যুবক। সুন্দরলাল বহুগুণা ও চণ্ডীপ্রসাদ ভাট। গাছকে ‘চিপকে’ বা জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, গাছ কাটার আগে আমাদের হত্যা কর। ধীরে ধীরে গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল এই আন্দোলন। ইতিহাসে এই আন্দোলন ‘চিপকো আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করল। তদানিন্তন সময়ের প্রেক্ষিতে সমগ্র বিশ্বে এই আন্দোলন ছিল বিশেষ বার্তাবহ। সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হল! আন্দোলন সফল হল।
চিপকো আন্দোলন এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল চিপকো আন্দোলন। এর দক্ষিণ ভারতীয় সংস্করণ হল ‘অ্যাপ্পিক্কো আন্দোলন’।
চীন-ভারত সীমান্ত(১৯৬৪-১৯৬৫)সংঘাতের সমাপ্তির সাথে সাথে দেশ জুড়ে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়। দেশি-বিদেশি অনেক কোম্পানি উত্তরাখন্ড হিমালয়ের এই মনোরম পরিবেশকে, কোম্পানি স্থাপন জন্যে ভাল একটা স্থান হিসাবে চিহ্নিত করত। যদিও গ্রামবাসীরা বাসযোগ্যতার জন্য বনভূমির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। খাদ্য ও জ্বালানির চাহিদা সহজেই মেটাত বনভূমি। কোম্পানিগুলি মূলত বিপুল পরিমানে বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতার কারণে লোভেরবশবর্তী হয়ে এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে; কিন্তু কোম্পানির জন্যে অনেক জায়গার প্রয়োজনের জন্যে প্রচুর পরিমানে গাছ কাটা শুরু হয় ও পরিবেশের উপর বেশি পরিমানে দুর্যোগ দেখা দিতে শুরু করে যেমন- খরা, বন্যা ইতাদ্যি। এই পরিস্থিতিতেই পরিবেশকে রক্ষার জন্যে চিপকো আন্দোলন শুরু হয়।
সুন্দরবাল বহুগুণা ছিলেন চিপকো আন্দোলন নেতা এবং মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা ও সত্যগ্রাহার দর্শনের অনুসারী। তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনে মিলে প্রথম এই আন্দোলনের পদক্ষেপ নেন ও এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেন এবং প্রচুর সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যান। বনভুমি রক্ষার জন্যে একটি সংগঠন গরে তুলেন।
১৯৭০ এর সময় থেকে এই আন্দলন শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৩ সাল থেকে এই আন্দোলন চরম আকার নেয় এবং ১৯৭৪ সালে সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
মহিলা ও পুরুষ সব নির্বিশেষে উভয় এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের মধ্যে সুবেদার দেবী, বাচ্চিনী দেবী, চণ্ডী প্রসাদ ভট্টা, গোবিন্দ সিং রাওয়াত, ধুম সিং নেজি, শমসের সিং বিশ্বাস এবং ঘানসিম রাতারু, আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বনভূমি রক্ষার নেতারা ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আবেদন করেন, এর ফলে হরিজন পত্রিকায় গাছ কাটা নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছিল। ২৬শে মার্চ প্রতি বছর চিপকো আন্দোলন দিবস হিসাবে পালিত করা হয়। ১৯৮০ সালে উত্তরপ্রদেশের অরণ্যে ১৫ বছর ধরে গাছ কাটা নিষিদ্ধ ছিল। এরপর হিমালয় রাজ্য, কর্ণাটক, রাজস্থান, বিহার, পশ্চিমঘাট অঞ্চলে ও বিহারে গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আজও চিপকো আন্দোলন ভারতের অন্যান্য পরিবেশ আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে রয়েছে।