তমসাচ্ছন্ন ভারত-সূর্য, আলোর দিশারি হবেন কে?
যশোবন্ত সিন্হা
১৯৪৬ সালের কথা, আমার বয়স তখন নয়। আমি পাটনার এক ছোট শহরে বেড়ে উঠছি। আশেপাশে কী ঘটে চলেছে তা নিয়ে আমি খবু একটা বেশি কিছু জানতাম না। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, “বজরংবলি কি জয়!” এবং “আল্লা হু আকবর” চিৎকার! ভয়ঙ্কর সেই নরসংহার থেকে থেকে রক্ষা পেতে পরিবারের বয়োঃজ্যেষ্ঠরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন। সৌভাগ্যবশত, আমাদের মহল্লায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাব পড়েনি। নিরাপদেই ছিলাম আমরা।
মনে আছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আমার স্কুলে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল। আমিও মিষ্টি নিয়েছিলাম এবং আমায় বলা হল আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম না যে, আমাদের দেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। শৈশব, দাঙ্গা, স্বাধীনতা এবং দেশভাগ; কোনটাই আমার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেনি। আমার মনে ছিল কেবল আমার দাদার বলা একটি গল্প।
সে ইউনিভার্সিটি ট্রেনিং কর্পস ক্যাম্পে গিয়েছিল, এবং ট্রেনে করে পাটনা ফিরছিল। তখন আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। সংকটজনক পরিস্থিতিতে সুরক্ষার স্বার্থে ক্যাডেটদের কম্পার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে বলা হয়েছে। ট্রেন যখন পাটনার কাছে মসুরহি স্টেশনে এল, তখন আমার দাদার পালা এল, এবার তাকে ট্রেনকে পাহারা দিতে হবে। সে বলেছিল, স্টেশন ভর্তি শুধুই মৃতদেহ ছিল। দাঁড়ানোর জায়গাটুকু অবধি ছিল না। ওই সব মৃতদেহ ছিল সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মারা যাওয়া মানুষদের, আমি কোনদিন সেই কথা ভুলব না। আমার অতীত-ইতিহাস, পূর্ব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমি আজীবন মুক্তমনা।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সারা দেশজুড়েই হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর শান্তির আহ্বানও ফলপ্রসু হয়নি, যতদিন না তিনি কলকাতায় আমরণ অনশন করেছিলেন। ওই একই সময়ে ভারতের কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্যরা সেন্ট্রাল হলে খসড়া সংবিধান তৈরি করছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২৯শে আগস্ট বি আর আম্বেদকরের নেতৃত্বে সাত সদস্যের সংবিধানের খসড়া কমিটি তৈরি হয়। সিভিল সার্ভিস অফিসার বি এন রাও-কে পরামর্শদাতা পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়।
সংবিধানের খসড়া কমিটির সদস্যরা প্রত্যেকেই দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুই দেশের বিপুল সংখ্যক জনগণের দেশত্যাগ এবং শরণার্থী হয়ে অন্যদেশে আসা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমান, দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে হিংসা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। পাকিস্তান মুসলমান রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছিল। ভারতেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু, ভারতের সংবিধানে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলার পক্ষে। এর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি অনেক পরে জরুরি অবস্থার সময় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
চরমতম সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, ভারত গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে গ্রহণ করেছে। গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, রাজেন্দ্র প্রসাদ, আম্বেদকরের মতো নেতারা ভারতকে তাঁদের নেতৃত্বের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন। তাঁরা কখনওই দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চাননি।
সেই ভারত ছিল একেবারে সেরা। শতকের পর শতকে যেমন ছিল ভারত, সেই সময়তেও ঠিক তেমন ছিল, সবার সেরা ভারতবর্ষ; উদারমনস্ক, সহিষ্ণু, সর্বভৌম এবং অহিংস সমাজ ব্যবস্থা। সাধারণ জনগণ আনন্দের সঙ্গে সাংবিধানকে গ্রহণ করেছিল।
কিন্তু আজ কীসের বদল হল? আমাদের স্বাধীনতা কি বিপন্ন? আমাদের ঐক্য কি বিপদের সম্মুখীন? আমাদের সংবিধান কি ব্যর্থ? হিন্দুরা কি বিপদে রয়েছেন? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপন্ন? না এসব কিছুই বদল হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে দেশের নেতৃত্বদের মানসিকতায়। সে সব মানুষের হাতেই ভারতের ভাগ্য নির্ভর করছে। তারা দেশকে নিজেদের মতো করে বদলাতে চান। হিংসার আঁতুরঘর বানাতে চান। তারা চান হিন্দুরা আতঙ্কে থাকুক। ভয় পাক। নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করুক হিন্দুরা। দেশে বর্তমানে যা ঘটে চলেছে তাতেও যদি হিন্দুরা আতঙ্কিত না হয়, তবে তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে সেই একই দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চান।
কিন্তু কীসের জন্য এমন করা? নির্বাচনে জেতার জন্য। ধর্মই হল ক্ষমতাপিপাসু-রাজনীতিকদের ক্ষমতা জয় করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার উপাদান হিসেবে হিন্দুত্বকে ব্যবহার করা ছাড়া, আর কোন কাজ নেই এদের। হিন্দুত্ব ঘৃণা এবং হিংসার শিক্ষা দেয় না। যে হিংসা, বিদ্বেষ ছড়ায় সে প্রকৃতি হিন্দু হতেই পারে না। দেশ এখন নেহেরু, প্যাটেল, বাজপেয়ীর মতো নেতৃত্বের অপেক্ষায়।
এই তমসাচ্ছন্ন পথের শেষে কি আশার আলো রয়েছে? আমি জানি না। আমার বয়স ৮৫। মানসিকভাবে আমি সতেজ কিন্তু শারীরিকভাবে আন্দোলন সক্ষম নই। কিন্তু আজকের ভারত প্রস্তুত হচ্ছে। আমার বিশ্বাস, ভারত পুরোপুরি অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ার আগে নিঃস্বার্থভাবে কোন ব্যক্তি, বা একদল মানুষ এগিয়ে আসবেন। সরকার বদলে ফেলা নয়, প্রশ্ন হল আদর্শের।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার লড়াইয়ে যারা আড়ালে ঢেকে ছিল, আজ তারাই সামনের সারিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার এবং সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। প্রতিদিন মিথ্যাচার ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ দেশবাসীর উপর প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে। এমনকি আমার নিজের বৃহত্তর পরিবারের মধ্যেও এ জিনিস হচ্ছে।
এও বলতে হয়, এই জাতীয় ঘটনা কেবল ভারতেই নয়; অন্য জায়গাতেও হচ্ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের লড়াই। ভারতের ক্ষেত্রে বিজেপি ভারতের ঐক্যকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছে। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের পরিসরকে খর্ব করা হচ্ছে। বাস্তবে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে জরুরি অবস্থার থেকেও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতীয়রা গণতন্ত্রের প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা এমন নেতৃত্ব চাই, যারা সঠিক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। কিন্তু ক্ষমতালোভীরা এমন নেতৃত্ব দিতে পারবে না। জয়প্রকাশ নারায়ণ সফল হয়েছিলেন, কারণ সে কোনদিন নিজের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাননি।
আমাদের এখন এমন একদল নেতৃত্ব চাই, যারা ঘোষণা করবে, নিজেদের ক্ষমতার জন্য নয়। আমরা আদর্শের জন্য লড়াই করছি। কেবল তখনই তাদের বিশ্বাস করা যাবে। আমি কি তা দেখে যেতে পারব কিনা? আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, সবরকম বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে একদিন মানুষ নিশ্চয়ই জাগবে।
ভারতের জনগনের উপর আমার গভীর আস্থা রয়েছে।
(লেখক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সহ-সভাপতি)