রিফিউজি’ থেকে ভারতীয় হয়ে ওঠার ৭৩ বছর
উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটা – ভারতের স্বাধীনতা আর দেশভাগ। ভারত আর পাকিস্তানের বহু মানুষের কাছে যেমন স্বাধীনতা দিবস আনন্দের, তেমনি লক্ষ লক্ষ বাঙালী আর পাঞ্জাবীদের কাছে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে নতুন দেশে পাড়ি দেওয়ার স্মৃতি বয়ে আনে স্বাধীনতার ইতিহাস। দেশভাগের পরের প্রথম নয় বছরেই পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন ২১ লক্ষেরও বেশী মানুষ।
সেই সব বাঙালী উদ্বাস্তুদের অনেকেরই দীর্ঘ জীবনসংগ্রাম শেষ হয়েছে এতগুলো দশকে। তবে ছেড়ে আসা দেশের কথা এত বছর পরেও মনে পড়ে তাঁদের। যদিও সেই সব উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর পরবর্তী প্রজন্ম এই সাত দশকে হয়ে উঠেছে পুরোপুরি ভারতীয়ই। বদলেছে যেমন তাঁদের মুখের ভাষা, তেমনই পাল্টেছে তাঁদের সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাও।
ভারত আর পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার ঠিক দুদিন পরে যে র্যাডক্লিফ লাইন টেনে উপমহাদেশের মানচিত্র চিরতরে পাল্টিয়ে দেওয়া হয়েছিল – তাতে একদিকে যেমন কোটি কোটি মানুষ নিজের দেশ পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন, অন্যদিকে কয়েক লক্ষ মানুষকে হারাতে হয়েছিল নিজের দেশ, নিজের ভিটেমাটি। যাদের কাছে এটা দেশ ছেড়ে চলে আসার, ছিন্নমূল হওয়ার বেদনা আজও গভীর।
এতগুলো বছর পেরিয়ে পূর্ববঙ্গ বা তারপরে পূর্ব পাকিস্তানের নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এসেছিল যেসব হিন্দু পরিবার, তারা এখন পুরোপুরি ভারতীয়ই হয়ে গেছেন। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের উদ্বাস্তুদের অনেকেরই এখনও ছবির মতো মনে রয়ে গেছে ছেড়ে আসা দেশের কথা, ভিটের কথা। “অহনও রাত্রে স্বপ্ন দ্যাহি দ্যাশের বাড়ির। নদীরে তো দ্যাশে গাঙ কইত। আমরা গাঙ্গে স্নান করতে যাইতাম। কত্ত কিসু মনে পড়ে, হায় কপাল,” বলছিলেন এক বৃদ্ধা।
দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, ফরিদপুর থেকে চলে আসা উদ্বাস্তু শান্তিরঞ্জন গুহর কথায়, “দেশের চার বিঘা জমিতে চারটা ঘর, দুইটা পুকুর ছিল। একটা চাইর পাড় বান্ধানো। গ্রামে কারও বিয়া-শাদি হইলে ওই পুকুর থিক্যা মাছ নিয়া যাইত। আর অন্য পুকুরটা নদীর সঙ্গে জোড়া ছিল – কত্ত রকমের যে মাছ সেখানে!”
নতুন গড়ে ওঠা সীমান্ত পেরিয়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতে আসার পরে বেশিরভাগেরই ঠাঁই হয়েছিল কলকাতার শিয়ালদা স্টেশনে। গবেষকদের সংগৃহীত তথ্য বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম নয় বছরে প্রায় একুশ লক্ষ মানুষ চলে এসেছিলেন ভারতে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে কেউ চলে যেতেন আত্মীয়-স্বজনের বাসায়, কেউ জায়গা খুঁজতে বের হতেন কলকাতার উপকন্ঠে জমি জবরদখল করে গড়ে ওঠা রিফিউজি কলোনিগুলিতে।
যাঁদের কোথাও যাওয়ার নেই, সেরকম উদ্বাস্তুদের ট্রাকে করে পাঠানো হতো বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরগুলিতে। সপরিবারে থাকার জন্য যেমন তৈরী হয়েছিল নদীয়ার কুপার্স ক্যাম্প বা ধুবুলিয়ার মতো বহু শিবির, তেমনই একাকী নারী আর তাঁদের শিশু সন্তানদের জন্য ছিল আলাদা শিবির। সরকারিভাবে এঁদের চিহ্নিত করা হয়েছিল পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি বা পিএল হিসাবে। এখনও পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন ৪৮১ জন পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি – যাঁদের ৭০ বছর ধরেই মাসোহারা, চাল-ডাল-গম আর পরণের ধুতি বা শাড়ি দেয় সরকার।
যেহেতু অনেক চেষ্টা করে লড়াই করে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করে তাঁদের নিজেদের ভারতীয় হয়ে উঠতে হয়েছে, তাই উদ্বাস্তুদের বর্তমান প্রজন্ম আর বিশেষ আলোচনা করে না দেশভাগ বা মনে করতে চায় না ছিন্নমূল হয়ে আসার পরে তাদের পূর্বপুরুষদের লড়াইয়ের কথা।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা