বাংলা মিডিয়াম নিয়ে বিতর্কের মাঝেই বাঙালির বিশ্বজয়! ও’হেনরি পুরস্কার পাচ্ছেন সাহিত্যিক অমর মিত্র
ও’ হেনরি সাহিত্য পুরস্কার (O. Henry Award) পেলেন সাহিত্যিক অমর মিত্র। ভারতীয় হিসেবে এবং অবশ্যই বাংলা ভাষার লেখক হিসেবেও এই প্রথম এই গর্বের পুরস্কার পেলেন তিনিই।
১৯৭৭ সালে অমর মিত্র লিখেছিলেন এক ছোটগল্প, ‘গাঁওবুড়ো’। তাঁর কথায়, “এটি আমার অল্প বয়সে লেখা গল্প।” এই গল্পটিই চার দশকেরও বেশি সময় পরে, গত বছর আমেরিকার একটি সাহিত্যপত্রিকা ‘দ্য কমন’-এ প্রকাশিত হয়। অনুবাদে তার নাম হয়, ‘দ্য ওল্ড ম্যান অফ কুসুমপুর’। সেখান থেকেই এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয় গল্পটি। গল্পের অনুবাদ করেছেন অনীশ গুপ্ত।
আমেরিকার প্রখ্যাত ছোটগল্পকার ও’ হেনরির নামে এই পুরস্কার (O. Henry Award) প্রবর্তন করা হয় ১৯১৯ সালে। ছোট ফিকশন গল্প ও ছোট ফিকশন গল্পের অনুবাদের জন্যই দেওয়া হয় এই পুরস্কার। ও’ হেনরি ছোট গল্পের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন। তাঁরই নামানুসারে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
সল বেলো, উইলিয়ম ফকনার, অ্যালিস মুনরো, আসাকো সেরিজাওয়া, ফ্রেডেরিক টুটেন, এলিজাবেথ ম্যাকক্র্যাকেন, উইলিয়াম ট্রেভর, স্টিফেন কিং, জন আপডাইকের মতো নামীদামি লেখকেরা এই পুরস্কার পেয়েছেন। ওঁদের বেশির ভাগই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজেতা। তাঁদের মাঝেই আজ জ্বলজ্বল করে উঠল বাংলার সাহিত্যিক অমর মিত্রের নাম।
বাংলার গ্রামের গল্প জিতল পুরস্কার (O. Henry Award)
যে গল্পটি এই অসামান্য পুরস্কার জয় করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আঙিনাকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলল, সে গল্পের প্রতিটি ছত্রে জড়িয়ে আছে রাঢ়বাংলার গ্রামীণ ছবি।
এ গল্পের চরিত্র কুসুমপুরের বুড়ো ফকিরচাঁদ। তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে আগেই। ছেলে পালিয়েছে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া একা বৃদ্ধের এখন বড় সাধ জেগেছে জীবনের। সাধ জেগেছে পরিবার গড়ে বাঁচার। এই জীবনের তাড়নায় বৃদ্ধ ফকিরচাঁদ একদিন ঠিক করেন, দশ মাইল দূরে দুর্গাহুড়ি জঙ্গল পেরিয়ে পশ্চিমে সুবর্ণরেখার তীরে কন্যাডিহা গ্রামে ‘বড়বাবু’র কাছে গিয়ে সমস্ত দুঃখ দূর করে আসবেন।
কে এই বড়বাবু, তা জানা যায় না। তবে সর্বসংকটমুক্তির লক্ষ্যে এক অজানা পথে যেতে যেতেই বুড়ো ফকিরচাঁদ সংগ্রহ করতে থাকেন আরও অনেক দুঃখ। কারও প্রেয়সীর সঙ্গে মিলন হচ্ছে না তো কেউ আবার কুষ্ঠের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে সমাজচ্যুত। সকলের সমস্ত সমস্যা ‘বড়বাবু’কে বলে সমাধান করে দেওয়ার আশ্বাস দিতে দিতে এগোতে থাকেন বৃদ্ধ, কন্যাডিহার পথে।
যেতে যেতে সন্ধে ঘনায়। লেখকের কলমে উঠে আসে অপূর্ব এক রূপক, “পৃথিবীতে চাঁদ ভেসেছে গেরুয়া বর্ণের ডিম্বাকার।” তার পরে কী হয় ফকিরের? পৌঁছনো হয় কি কন্যাডিহা? ফেরা হয় কি সব সমস্যার উপশম নিয়ে? ছোট্ট নদীর তিরতিরে গতির মতোই এগোয় লেখকের মায়াময় বর্ণনা। একসময় ফুরোয় গল্প। একসময় কলমের শব্দেরা “সব নৈঃশব্দে ডোবে। তারপর একসময় সবুজ আলো জ্বালিয়ে এক উড়োকল নৈঃশব্দ ভেঙে চলে যায়।”
বাংলার এমন আপন গল্প নিজগুণেই এত বছর পরে জায়গা করে নিয়েছিল আমেরিকার পত্রিকায়। সেই জন্যই না মিলল এমন সম্মান (O. Henry Award)! সাহিত্যিক অমর মিত্রর এই গল্প নিয়ে ছবি করার তোড়জোড়ও করেছিলেন পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। ২০১৮ সালে পুরুলিয়ায় এই ছবিটির শ্যুটিংও শুরু হয়েছিল। অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত ঝুমুর গায়ক অমূল্য কুমার। কিন্তু সে ছবি আলোর মুখ দেখেনি।
কিন্তু কুসুমপুরের গাঁওবুড়োর গল্প অন্য এক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আজ। সে আলোর জোয়ারে ভাসল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যও।
প্রসঙ্গত, সাহিত্যিক অমর মিত্রর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মিলন হবে কত দিনে’ গত কয়েক মাস ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে দ্য ওয়ালের ডিজিটাল সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘সুখপাঠ‘-এ। তাই এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লেখকের এই সম্মানে দ্য ওয়াল বিশেষ ভাবে আনন্দিত ও গর্বিত।