আরআরআর থেকে কাশ্মীর ফাইল; বিজেপির হিন্দুত্ব ছড়ানোই কি উদ্দেশ্য চিত্রনির্মাতাদের?
মোদী আমলে ভারতে চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে বিজেপি-প্রনোদিত মিথ্যাচার প্রচারের মাধ্যম, অজান্তেই ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার কারিগর হয়ে উঠছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মতারা। কাশ্মীর ফাইল থেকে আরআরআর, সর্বত্র একই চিত্র।
ঋত্বিক ঘটকও রাজনৈতিক ছবি বানাতেন, বিবেক অগ্নিহোত্রিও রাজনৈতিক ছবি বানাচ্ছেন, দুটোই কী এক?
প্রখ্যাত দক্ষিণী পরিচালক এস এস রাজামৌলি পরিচালিত প্যান-ইন্ডিয়ান চলচ্চিত্র আরআরআর মুক্তি পেয়েছে, মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই বক্স অফিসে রীতিমতো ঝড় তুলেছে এই ছবি। আয়ের নিরিখে সর্বকালের সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্রের তালিকায় ইতিমধ্যেই স্থান পেয়েছে আরআরআর। পাঁচটি ভারতীয় ভাষায় মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটি বাস্তব জীবনের নায়ক আলুরি সীতারাম রাজু এবং কোমারাম ভীমের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি কল্প-কাহিনী। এরা দুজনেই প্রতিবাদী, আদিবাসীদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন আবার পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও বাস্তবে তাদের দুজনের সাক্ষাত হওয়ার, এক সঙ্গে অধিকারের লড়াই লড়ার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, তবে চলচ্চিত্রতে একটি বিশেষ কারণেও তাদের একসাথে দেখা করিয়ে, ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ানো হয়েছে।
চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পরেই, এই দুই আন্দোলনকারীকে হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের আদলে উপস্থাপন করার জন্যে দর্শকদের একটি অংশের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। আল্লুরি সীতারাম রাজু (রাম চরণ যে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন), গেরুয়া পোশাক পরা সন্ন্যাসীর ভূমিকায় যাকে ছবিতে দেখা গিয়েছে। সে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করে এবং সংস্কৃত শ্লোকগুলির পাঠ করতে করতে তিনি রামায়ণের রামে রূপান্তরিত হন। কোমারাম ভীম (জুনিয়র এনটিআর যে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন), একজন গোন্ড উপজাতির নেতা, যিনি হায়দ্রাবাদের নিজাম এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, তাকে ভগবান রামের বিশ্বস্ত ভক্ত হনুমান এবং মহাভারতের ভীম রূপে ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে, শারীরিক শক্তির জন্যে যে পরিচিত ছিল। চলচ্চিত্রটি ধার্মীক ও জাতীয়তাবাদী উভয় আঙ্গিকে উপস্থাপিত করতে গিয়ে, দুই চরিত্রকে সম্পূর্ণ ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বহু প্রেক্ষাগৃহে দর্শকেরা ‘জয় শ্রীরাম’-চিৎকারে এই ছবিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের অধ্যাপক শ্রীনিবাস এসভি বলেছেন, “ঐতিহাসিক বিকৃতির প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে বলি, এই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যই হল; এমন একটি চলচ্চিত্র তৈরি করা যা সারা দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়।”
২০১০ সালে রজনীকান্তের এন্থিরনের পর থেকেই দক্ষিণে প্যান-ইন্ডিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাণের জোয়ার এসেছে। দেশব্যাপী বাণিজ্যের লক্ষ্যে অন্যতম বড় বাজেটের ছবি ছিল এটি। ভাষার বাধাকে অতিক্রম না করতে পারলে এত বড় চলচ্চিত্র তৈরির করার কোন মানেই থাকে না। তারপর থেকে বাহুবলি, রোবট ২.০, কেজিএফ, পুষ্পা ইত্যাদির মতো চলচ্চিত্র তৈরি হতে শুরু হয়েছে। আরআরআর এই জাতীয় চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি। দেশব্যাপী হিন্দি দর্শকদের কাছে পৌঁছনো এবং বাণিজ্যিক লাভের জন্য আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরা হচ্ছে।
চলচ্চিত্র সমালোচক সনকীর্তন দন্তুলুরি বলেছেন, ‘রাম এবং ভীমকে এমনভাবে দেখানো অসম, প্রথমার্ধ অনুযায়ী, কাল্পনিক চরিত্রগুলি কাল্পনিকই থাকে। ভীমকে এখানে একজন মুসলমান মানুষ হওয়ার ভান করিয়ে ছবিকে একটি সুন্দর অনুভূত দেওয়া হয়েছে। একজন সংখ্যালঘু অন্যকে বিশ্বাস করতে পারে, তবে ভীমের সঙ্গে রামের যেসব ঘটনা দেখানো হয়েছে তা সন্দেহজনক। রাম একটি চেয়ারে বসে থাকে এবং ভীম তার প্লেট নিয়ে আসে এবং রামের পায়ের কাছে বসে। এই ধরণের দৃশ্যায়ণের উদ্দেশ্য হতে পারে যে একজন আদিবাসী মানুষ মাটিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে রাম উচ্চবংশীয় তাই এমন বৈষম্য দেখানো হয়েছে।’
তার কথায়, বিভিন্ন সংগ্রামীদের সঙ্গে পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে মিলিয়ে দিয়ে এমনভাবে পুনরায় নির্মাণ করা বিভ্রান্তিকর। তিনি বলেন, “ছবির দ্বিতীয়ার্ধে পৌরাণিক আঙ্গিকটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। আমি বুঝতে পারি যে একজন তেলুগু বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতার হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীকে এই জাতীয় মিশ্রণের মধ্যে নিয়ে আসার প্রবণতা থাকে। শেখর কামুলার মতো চলচ্চিত্র নির্মাতাও গোদাবরীতে তার ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করা জুটির নামে রাম-সীতার নামে রাখা থেকে বিরত থাকতে পারেননি। রাম চরণ যখন আল্লুরি সীতারাম রাজুর পোশাক পরে আসেন, তখন একটি শ্লোক বাজতে শুরু হয়, এটি কেবলমাত্র ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই হয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীর জন্য এমনটা হয় না। ভীম যখন জল থেকে বেরিয়ে আসে তখনও একই ঘটনা ঘটে। রাজামৌলি সম্ভবত এই মুহুর্তটির তীব্রতাকে বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যাতে ছবিকে আরও বেশি করে হিন্দুত্ববাদী তথা জাতীয়তাবাদী করে তোলা যায়।”
ছবির পরিচালক একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তেলুগু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্পর্কে তিনি দেশকে জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছবিটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে কিছুই বলে না। বরং সেই আবেগকে ব্যবহার করে দর্শকদের ধর্মের মূলত আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের পাঠ পড়াচ্ছে আরআরআর।
প্রসঙ্গত, আরও একটি ছবির কথা উঠে আসে, বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত দ্য কাশ্মীর ফাইলস, যা ১১ ই মার্চ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। মাত্র আট দিনের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা আয় করে, এই ছবি রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। এই চলচ্চিত্রটিও একটি বাস্তব ঘটনাশ্রিত কাল্পনিক গল্প, বলা ভাল একপাক্ষিক কাহিনী। যা ৮০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা তাদের মাতৃভূমি থেকে কিভাবে বিতাড়িত হয়েছিল,সেই কাহিনী বলেছেন পরিচালক। সুস্পষ্টভাবে এবং উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে, এই ছবি মুসলিম-বিরোধী প্রচার করে। চলচ্চিত্রটি কাশ্মীরি পণ্ডিতের যন্ত্রণার কথা বলেছে এবং কাশ্মীরি মুসলমানদের বর্বরতার কথাও বলেছে, কিন্তু মুসলোমানরাও যে আক্রান্ত হয়েছিল তা চেপে যাওয়া হয়েছে ছবিতে।
বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা ইচ্ছে করে ছবিটির প্রচার করছে; যার নেপথ্যে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। ছবি মুক্তির ঠিক একদিন পরে, পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী, অভিনেত্রী পল্লবী জোশী (বিবেককের স্ত্রী এবং এই ছবির অভি নেত্রী) এবং ছবির প্রযোজক অভিষেক আগরওয়াল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে দেখা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সকল বিজেপি নেতা ছবিটির দরাজ প্রশংসা করেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব থাকায় চলচ্চিত্রটি আরও গুরুত্ব পায়। এরপরে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার ছবিটিকে করমুক্ত করে তোলে।
অধ্যাপক শ্রীনিবাসের মতে আরআরআর-এর সময় সিনেমা হলে যে ‘জয় শ্রীরাম’ চিৎকার হচ্ছে, দ্য কাশ্মীর ফাইলস মুক্তির পরে সেই প্রবণতার জন্ম হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আরআরআর বহু বছর আগে কল্পনা করা হয়েছিল, এবং প্রেক্ষাগৃহে ‘জয় শ্রীরাম’-এর ধ্বনি দেওয়ার চল সেই সময় ছিল না। কাশ্মীর ফাইলসের সঙ্গে সঙ্গেই এই স্লোগানটি একটি বৃহদাকার ধারণ করে, খুব দ্রুত এই ট্রেন্ডও শেষ হবে।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বলিউডের গেরুয়াকরণ ঘটেছে। কাজেই কাশ্মীর ফাইলসের সাফল্য অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়, সমাজকেও ওইভাবে ভাবতে বাধ্য করা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব, ঐতিহাসিক হিন্দু আইকন নির্মাণ, হিন্দুদের কষ্ট, হিন্দুদের উপর অত্যাচার সবকিছুই বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য প্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে, মুসলমানদের ক্ষতিকারক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
২০১৪ সালে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই দেশজুড়ে ধর্মীয় বিভেদের আবহ তৈরি করা হচ্ছে। সঙ্ঘ পরিবার অর্থাৎ আরএসএস হিন্দুত্বের ধ্বজা দেখিয়ে দেশকে বিভাজিত করতে নেমে পড়ছে। এই সিনেমাগুলো সমাজের সর্বস্তরে সেই প্রপাগাণ্ডাকে পৌঁছে দিচ্ছে।
ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘বলিউড: ‘আদারিং দ্য মুসলিম অন স্ক্রিন’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে, লেখক প্রণব কোহলি এবং প্রণব ধাওয়ান লিখেছেন, “২০১৬ সাল থেকে, হিন্দি ভাষায় বাজিরাও মস্তানি, পদ্মাবত, মণিকর্ণিকা, পানিপথ এবং তানহাজির মতো বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক কাহিনী নির্ভর ছবি তৈরি হয়েছে। আদপে বলিউডের ইতিহাস নিয়ে মাথা ব্যথ্যা নেই বরং হিন্দুদের ইতিহাস নিয়ে তাদের কারবার। যা সহজেই জনপ্রিয়তা আদায়ের হাতিয়ার। বলিউডে ঐতিহাসিক কল্পকাহিনীর সাম্প্রতিক ঢেউতে এমন গল্পগুলি তুলে ধরা হচ্ছে যা আগে কখনও দেখা হয়নি, প্রকৃতিপক্ষে এটিই পরিচিত ও প্রচলিত ইতিহাসের হিন্দুত্ববাদী সংস্করণ। তাদের মহারম্বারে, মোড়কের সাহায্যে পরিবেশন করা হচ্ছে। ইতিহাসের উপর হিন্দুত্বকে এক প্রকার জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বিকৃত ইতিহাসের প্রচার মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র।
ইতিহাসকে সেলুলয়েডের জন্য এর আগেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে, হিন্দুত্বের মোড়কের প্রয়োজন তখন হয়নি। মধ্যযুগীয় রাজনীতির জটিলতাকে রাজাদের মধ্যে ঘটতে থাকা ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের উদাহরণ হিসেবে মুছে ফেলে, এই চলচ্চিত্রগুলো হিন্দু রাজাদের মুসলমান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে লড়ার গল্প বলে। এ জিনিস ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া আর কী?
দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর নায়ক একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত ছাত্র, জনগণের দুঃখকষ্ট সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত একটি বক্তৃতা দিয়েছেন, যাকে উত্তেজক এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য বলা যায়। সেখানেই বলা হয়েছে সিকান্দার শাহ মিরি, একজন মুসলিম রাজা, যিনি ১৩০০ সাল নাগাদ কাশ্মীর আক্রমণ করেছিলেন, সেই সঙ্গে এও বলা হয় যে তিনি মন্দির ও মন্দির ধ্বংস করেছেন। চলচ্চিত্রটি মধ্যযুগীয় ইতিহাসকে উপজীব্য করে তৈরি হয়েছে। ছবিতে এমন এক সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে, যখন রাজনৈতিক, সামাজিক রূপরেখাগুলি ভিন্ন ছিল, এবং রাজাই ছিলেন নিয়ন্ত্রক। আধুনিক ইতিহাসে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিহাসের চলচ্চিত্রায়ণ এমনভাবে করা হয়েছে যে নিষ্ঠুর, ধ্বংসাত্মক শাসকরা সর্বদা মুসলমান হয়, সাহসী রাজারা সর্বদা হিন্দু হয়, তারা দয়া মায়ায় মেশা মানুষ, মুসলমানদের মতো নিষ্ঠুর নন। মারাঠি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও এই জাতীয় ছবি নির্মাণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মারাঠি চলচ্চিত্র নির্মাতা দিগপাল লানজেকরের জনপ্রিয় ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র, সর্বশেষ পবনখিন্দ, একই ভাবে তৈরি হয়েছে। অভিজিত দেশপান্ডে পরিচালিত আসন্ন মারাঠি ছবি হর হর মহাদেবের টিজারে ছত্রপতি শিবাজিকে রাজা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, যিনি এমন এক সময়ে অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন যখন মহিলাদের অসম্মান এবং মন্দির ধ্বংসকে অপরাধ বলে মনে করা হত না। অর্থাৎ মহাত্মের প্রচার।
তবে দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে, ঐতিহাসিক কাহিনীকে হিন্দু-মুসলমান বাইনারির সহজ সরল সমীরণে দেখানো হয় না। কিন্তু এটাই বলিউডের আদৰ্শ হয়ে উঠেছে। মালায়ালাম সিনেমায়, যেখানে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় জনসংখ্যার নিরিখে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। সেখানে সেই ধর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি প্রীতি নয়! আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ব্যবসায়িক লাভের মধ্যে, যা ধর্মীয় আবেগকে হাতিয়ার করে গজিয়ে উঠেছে।
যদিও হিন্দুভাবাবেগের সূত্রপাত আজকেই প্রথম হয়নি। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত We or our Nationhood Defined বইটির লেখক তথা আরএসএসের দ্বিতীয় প্রধান এমএস গোলওয়ালকর, তার বইকে এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, যা সংঘের মতাদর্শকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছিল। এই বইটি, একটি হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের কল্পনা করে এবং এখানেই হিন্দুদেরকে জাতি বলে অভিহিত করা হয়েছেও এবং অন্যান্য ধর্মের লোকদের বিদেশী বলে অভিহিত করে। জার্মানিকে তার ইহুদি-বিরোধীতা, ফ্যাসিবাদ এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের জন্যও মহিমান্বিত করে। গোলওয়াকর পরে দাবি করেন, বইটি আসলে আরএসএসের পাঁচ প্রতিষ্ঠাতা এবং গণেশ দামোদর সাভারকর দ্বারা রচিত হয়েছিল এবং তিনি কেবল মারাঠি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। ২০০৬ সালে, আরএসএস বইটি প্রত্যাখ্যান করে। আরএসএসের মূল মতাদর্শ এই গ্রন্থ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং মুসলমানভীতি, হিন্দুত্ব গর্বের আখ্যান হয়ে উঠেছে বইটি।
জার্মান স্বৈরাচারী হিটলার এবং ইতালীর মুসোলিনির প্রতি আরএসএসের প্রশংসা কোনও গোপনীয় বিষয় নয়। দুই নেতাই ব্যাপকভাবে সিনেমাকে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন; অর্থাৎ দীর্ঘকাল ধরেই সিনেমাকে ন্যারেটিভ তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যুগে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রকে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে। স্বভাবতই ভারত তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রচারের জন্য একটি মাধ্যম হিসাবে সিনেমাকে ভারত বহুকাল ধরেই ব্যবহার করা হচ্ছে। হিন্দি চলচ্চিত্র দেশের বৃহত্তম চলচ্চিত্র মাধ্যম। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে, প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘ফিল্ম অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির’ একটি প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা করেছিলেন। এক মাসের ব্যবধানে বলিউডের লোকজনের সাথে আরও দুটি বৈঠক করেছিলেন। প্রথম বৈঠকের পরে, চলচ্চিত্রের টিকিটের জন্য পণ্য ও পরিষেবা কর হ্রাসের ঘোষণা করা হয়েছিল। এমন একটি পদক্ষেপ যা চলচ্চিত্র অভিনেতাদের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে, প্রধানমন্ত্রী বলিউডের বেশ কয়েকজন তারকা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, যাতে এই শিল্প মাধ্যমটি “জাতি গঠনে” কী ভূমিকা পালন রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
অক্ষয় কুমার এবং কঙ্গনা রানাউতের মতো বেশ কয়েকজন তারকা, প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন এবং তাদের চলচ্চিত্র, সাক্ষাতকার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের অবস্থান, বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান এবং মতাদর্শকে প্রসারিত করার জন্য পরিচিত, তারা রাষ্ট্রের কাছে অর্থাৎ বিজেপি সরকারের কাছ থেকে সুফল পেয়েছেন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে, সাধারণ নির্বাচনের চতুর্থ দফার মাত্র কয়েক দিন আগে, প্রধানমন্ত্রী মোদী অক্ষয় কুমারকে একটি অরাজনৈতিক সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন – ‘কঠিন’ প্রশ্নগুলির মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে আম খেতে পছন্দ করেন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে পি এম নরেন্দ্র মোদী ছবির মুক্তির অনুমতি দিতে অস্বীকার করার পরে এই সাক্ষাতকারটি হয়েছিল। ২০২১ সালের মে মাসে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং বারবার টুইটারের নীতি লঙ্ঘনের জন্য কঙ্গনা রানাউতকে টুইটার থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ওই বছরের শেষ দিকে তিনি উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডুর কাছ থেকে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী, যিনি দ্য কাশ্মীর ফাইলস তৈরি করেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন, তিনি “আরবান নকশাল” শব্দটি উদ্ভাবন করেছিলেন বলে জানা যায়।
এখন চলচ্চিত্রগুলি বিজেপির প্রচারের ইস্তাহারে পরিণত হয়েছে, বলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতাদের এই প্রবণতার ছবি নির্মাণ করে বিজেপির ঘরের লোক হয়ে উঠছেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে, উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক একটি বিশাল হিট হয়ে ওঠে, বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি আয় করে। চলচ্চিত্রটি ২০১৬ সালে পাকিস্তানি জঙ্গি আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিক্রিয়ার একটি কাল্পনিক বিবরণ, ভারতে সাধারণ নির্বাচন শুরু হওয়ার তিন মাস আগে ছবিটি মুক্তি পায়। উরি এই ধারণাটি তুলে ধরেছে যে, বর্তমানে বিজেপির নেতৃত্বে ভারত একটি ‘নতুন ভারত’ যা এই ধরনের আক্রমণ বরদাস্ত করবে না। বিরোধীরা যখন ভোটের জন্য সেনা অভিযানের রাজনীতিকরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছিল, তখন বড় পর্দায় এই আক্রমণে ভারতের প্রতিক্রিয়া দেশজুড়ে বিজেপি বান্ধব আবহ তৈরি করেছিল।
২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মুল্ক-এর মতো চলচ্চিত্রগুলি, দেশে ব্যাপকভাবে মুসলমানভীতি নিয়ে আসে, যা তদানিন্তন সময়ে বলিউডে বিরল ছিল। রাজি এবং সর্দার উধম-এর মতো চলচ্চিত্রগুলি জাতীয়তাবাদী হাওয়া তুলেছিল। কার্যত এটাও মিথ্যাচারের হাতিয়ার।
এদিকে, আদিপুরুষ, রামায়ণের উপর ভিত্তি করে নির্মিত, ওম রাউত পরিচালিত একটি মেগা বাজেটের চলচ্চিত্র, ২০২৩ সালে ছবিটি মুক্তি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ৫০০ কোটি টাকার বাজেটে তৈরি এই প্যান-ইন্ডিয়ান ছবিটি সেই বছরই মুক্তি পাবে, যে বছর অযোধ্যায় দীর্ঘ বিতর্কিত রাম মন্দির উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মন্দিরটি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আরএসএসের স্বপ্নের প্রকল্প এবং বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে রামমন্দির বছরের পর বছর ধরে উপস্থিত ছিল।
বলাইবাহুল্য বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে নিজেদের মাটি শক্ত করার জন্যে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করছে। তাসখন্ড ফাইল, অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার এই সবই রাজনৈতিক ছবি এবং বিজেপির প্রচারের মাধ্যম, ২৪-এর আগেই এবারও বিজেপি ঘর গোছাতে সিনেমাই হাতিয়ার করছে। ব্যবসা এবং জনপ্রিয়তা পেতে চিত্রনির্মাতারাও বিজেপির ফাঁদেই পা দিচ্ছেন।