আধুনিকীকরণের মোড়কে জালিয়ানওয়ালা বাগের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা মোদী সরকারের?
ব্রিটিশের অত্যাচারে পরাধীন ভারতের ইতিহাস বরাবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসের অন্যতম নারকীয় হত্যাকাণ্ড ছিল জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড। দেশবাসীর রক্তে রাঙানো, সেই গণহত্যার মেমোরিয়াল পার্কের সংস্কার করতে উদ্যাগী হয়েছে মোদী সরকার। যা নিয়ে ভারতীয়রা রীতিমতো ক্ষুব্ধ।
বিগত বছরের অগাস্ট মাসে, অমৃতসরের উত্তরে নবনির্মিত জালিয়ানওয়ালা বাগ কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগে একটি প্রতিবাদী জনসভা চলাকালীন সেখানে যোগ দেওয়া শত শত ভারতীয়কে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। ওইদিন বৈশাখী উৎসব আয়োজিত হয়েছিল। রাওলাট আইনের প্রতিবাদে, সেদিন জমায়েত হয়েছিল। ওই জনসভায় অনৈতিকভাবে, জেনারেল ডায়ার ভিড়ের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ব্রিটিশ সূত্রে দাবি করা হয়, ওই ঘটনায় ৩৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আদপে ১,০০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। জালিয়ানওয়ালা বাগ গোটা ভারতকে উদ্বেলিত করেছিল, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল জালিয়ানওয়ালা বাগ।
ওই সময় থেকেই জালিয়ানওয়ালা বাগের প্রাঙ্গণ, পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ, প্রবেশদ্বার, এবং প্রবেশপথ ইত্যাদি ভারতের করুন-বেদনাদায়ক অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। স্মৃতি স্মারকগুলো আমাদের শহীদদের স্মৃতি বহন করছে। সারা বিশ্ব থেকেই পর্যটকেরা এখানে আসেন।
সরকার এখন এখানে মিউজিয়াম তৈরি করেছে। ১৩ই এপ্রিল, ১৯১৯ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য প্রতিদিন সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো-এর আয়োজন করা হয়। ওই দিন একটি সরু গলি পথ দিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরএইচ ডায়ারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা জালিয়ানওয়ালা বাগ উদ্যানে প্রবেশ করেছিল। সেই দিন ইংরেজদের অতর্কিত আক্রমণে যারা মারা গিয়েছিল, তাদের স্মরণে ওই গলি পথের দেওয়ালে বিভিন্ন মূর্তি, স্থাপত্য-ভাস্কর্য দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে শহীদ কূপ, যেখানে প্রাণ বাঁচতে অনেকেই ঝাঁপ দিয়েছিল। সেই শহীদ কূপকে একটি স্বচ্ছ আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মোদী বলেছিলেন, “জালিয়ানওয়ালা বাগের সংস্কার হওয়ায় ফলে, নতুন প্রজন্ম এই পবিত্র স্থানের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। স্মরণ করতে পারবে। অতীত সম্পর্কে শিখতে অনুপ্রাণিত করবে”।
কিন্তু সমালোচকেরা মোদীর এই উদ্যাগকে স্পর্শকাতর বলে অভিহিত করেছেন। তারা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ইতিহাসকে মুছে ফেলার এবং বিকৃত করার চেষ্টার অভিযোগ করেছেন। ইতিহাসবিদ কিম ওয়াগনার বিজেপি সরকারের এই পদক্ষেপকে “পুরানো শহরের অমৃতসরের সাধারণ ডিজনিফিকেশনের একটি অংশ” বলে অভিহিত করেছেন, তিনি আরও যোগ করেছেন যে, “জালিয়ানওয়ালা বাগের সংস্কারের অর্থ হল ঘটনাটির শেষ চিহ্নগুলি মুছে ফেলা”।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তথা ইতিহাসবিদ চমন লাল বলেন, ” এই সংস্কারের নামে ইতিহাসকে রহস্যময় ও গ্ল্যামারাইজ করার চেষ্টা চলছে।” এক বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, “ব্যথা এবং যন্ত্রণার অনুভূতি নিয়ে মানুষের জালিয়ানওয়ালা বাগ দেখতে যাওয়া উচিত।” কিন্তু সরকার এখন জালিয়ানওয়ালা বাগকে সুন্দর বাগানসহ বিনোদন এবং আনন্দ উপভোগের জায়গায় পরিণত করার চেষ্টা করেছে।”
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিব একে “স্মৃতিসৌধের কর্পোরেটাইজেশন” বলে অভিহিত করেছেন, যা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিনিময়ে করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এটি সম্পূর্ণ আড়ম্বরপূর্ণ এতো আড়ম্বর কীসের? দেওয়ালে এত স্থাপত্য বা ভাস্কর্যই বা থাকবে কেন?”
রাজনৈতিক বিরোধীরা মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। কংগ্রেস থেকে শিবসেনা সকলেই তীব্র বিরোধীতা করেছেন। ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ সাংসদ প্রীত কৌর গিলও “আমাদের ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে। কেন?”-বলে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মোদী, তার দল এবং সঙ্ঘ পরিবার অবদান অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো। সেইকারণেই দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে, নতুন করে দেশের ইতিহাস লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মোদী সরকার।