রাজ্য বিভাগে ফিরে যান

পীরের দরগায় শিবের গাজন, সম্প্রীতির ছবি ধরা দেয় এই বঙ্গে

April 14, 2022 | 3 min read

সৌভিক রাজ

চৈত্র মাস মানেই শিবের মাস, বাংলা সনের শেষলগ্নে চৈত্র মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় শিবের পুজো। বাংলার লৌকিক সংস্কৃতির অনন্য অঙ্গ হলেন শিব। শিবকে ঘিরেই বাংলায় পালিত হয় একাধিক লৌকিক পার্বণ, তার মধ্যে অন্যতম হল গাজন।

গাজন আদ্যন্ত হিন্দুদের উৎসব, কিন্তু সম্প্রীতির বাংলায় পীরের দরগাতেও শিবের গাজন দেখা যায়। হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া থানার বানীবন গ্রামে অবস্থিত পীর জঙ্গল বিলাসের দরগায় দেখা যায় এই ছবি।

শিবের গাজন হয় হাওড়ার এই দরগায় - Uluberia Sambad
শিবের গাজন হয় হাওড়ার এই দরগায়, ছবি সৌঃ উলুবেরিয়া সংবাদ

ধর্ম নিয়ে উত্তাল আজকের ভারতে, সেখানে শিবের গাজন নিয়েও অনন্য বাংলা, বাণীবন গ্রামের পীরপুর পল্লীর প্রধান আকর্ষণ হল পীর আব্বাসউদ্দিন শাহের কবরস্থান। এই কবরস্থান সাধারণের কাছে জঙ্গল বিলাস পীরের কবর নামে পরিচিত। পীরের দরগার স্থাপত্যে বাংলার চারচালা মন্দিরের স্থাপত্যরীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত মসজিদের প্রবেশপথ পূর্ব দিকে হয় কিন্তু এই মসজিদ বা মাজারের প্রবেশ পথ দক্ষিণমুখী। দক্ষিণ দরজার কারিগরিতেও মন্দিরের ভাস্কর্যশৈলী, পোড়ামাটির অলংকরণ লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এমন মাজার বাংলায় আর খুব একটা দেখা যায় না।

শিবের গাজন হয় হাওড়ার এই দরগায়...Gajan is observed in the dargah of  jungle pirbaba baniban – News18 Bangla
পীর আব্বাসউদ্দিন শাহের দরগা, ছবি সৌঃ নিউজ ১৮

হিন্দু বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী পৌষসংক্রান্তির দিন পীরের দরগায় উৎসব পালিত হয়; এমন দৃশ্য কি আর কোথাও দেখা যায়। গাজন উৎসবের অন্তিমপর্বে অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বা নীল পুজোর দিন স্থানীয় শিব ঠাকুরের মন্দিরে বাঅন্যান্য শিবক্ষেত্রে, শিব ঠাকুরের বা নীলকণ্ঠ শিবের ঝাঁপ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ওই দিন বিকালে অথবা সন্ধ্যায় বাণীবনের অন্তর্গত বৃন্দাবনপুর গ্রামের এবং বৃন্দাবনপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী জগৎপুর গ্রামের গাজন দুটি, পীর জঙ্গল বিলাসের দরগার এসে সমবেত হয়। প্রথমে পীর জঙ্গল বিলাস সাহেবের মাজারের চারপাশের স্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠাগুলিতে গিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিককে আশীর্ব্বাদ করে। তারপর ঢাক ও কাঁসির বাদ্য সহযোগে বাবা ভোলা মহেশ্বরের চরণের সেবা লাগে বলে জঙ্গল বিলাসের মাজারটি পরিক্রমা করে। তারপর গাজন দু-টির মূলসন্ন্যাসী সন্ন্যাসধর্মবিহিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পিরের মাজারে পিরের উদ্দেশ্যে পুজো করেন। তারপর গাজন দু’টির সমস্ত সন্ন্যাসী পীরের মাজারের পূর্বদিকে থেকে পশ্চিমুখী হয়ে কয়েকটি সারিতে দাঁড়িয়ে পড়েন। সম্মুখে থাকেন দুই গাজনের দুই মূল সন্ন্যাসী। এরপর কৌলিক অধিকারসূত্রে বৃন্দাবনপুর গ্রামের ভুঁইয়া পরিবারের কোন এক ব্যক্তি সারিবদ্ধ সন্ন্যাসীগণের সম্মুখে উত্তরমুখে বসে একটি দীর্ঘ ছড়া পাঠ করেন। এই ছড়া পাঠকে ‘দ্বারমুখ’ বলা হয়। ছড়া পাঠের সঙ্গে মূলসন্ন্যাসীদ্বয়কে অনুসরণ করে সারিবদ্ধ সন্ন্যাসীগণ নানা রকম মুদ্রা সহকারে মাথাচালা, বেতনাড়া ও সন্ন্যাসধর্ম অনুসারে শিব পুজোয় পালনীয় সব কিছু করে থাকেন।

গাজন কি? কি উপলক্ষে এই উৎসব হয়? কোথায় হয় ? আলোচনা হলো বিস্তারিত
গ্রামের গাজন , ছবি সৌঃ সবারজন্যই

পীর জঙ্গল বিলাস বাণীবনের গ্রাম দেবতা। মূলত তিনি বাঘের দেবতা হিসাবে পরিচিত হলেও ভক্ত জনের বিশ্বাসে তিনি সর্ব বিপদের পরিত্রাতা ও রক্ষাকর্তা। সেকারণে আজও গরুর প্রথম দুধ, গাছের প্রথম ফল পীরকে না দিয়ে কেউ ভোগ করেনা। এছাড়া গৃহারম্ভ, গৃহপ্রবেশ, শিশুর মুখে ভাত, ব্যবসা বাণিজ্যের পত্তন, বিদেশ যাত্রা, স্বদেশ প্রত্যাগম ও যেকোন শুভ উদ্যোগের জন্য পীর জঙ্গল বিলাসের শিরণি বা পুজো দেওয়া হয়। রোগ নিরাময়ের জন্যে ধরনা দেওয়া, পঙ্গু বা বিকলঙ্গ শিশুর জন্য মাটির ঘোড়া দেওয়া, রুগ্ন শিশুর স্বাস্থ্যকামনায় শোলার সঙ্গে চালের পুঁটুলি বেঁধে পীরের পুণ্য পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠানগুলি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই পালন করে। এছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার পুণ্য পুকুরে স্নান ও শিরণি দেওয়া হয়।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Harmony, #Pir dargah, #West Bengal

আরো দেখুন