আজই ঘুরে আসুন পলাশীর প্রান্তর থেকে
ছবিতে দেখা যাচ্ছে পলাশী যুদ্ধের ২৬৩ বছর পর সেই রণপ্রান্তর, আম্রকানন যেখানে এক অসমযুদ্ধে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা । আমরা আবদ্ধ হয়েছিলাম গোলামীর জিঞ্জরে ।
কলকাতা থেকে ১৭২ কিলোমিটার দূরে পলাশী । বহরমপুরগামী এক্সপ্রেস বাসে করে মীরা পলাশী স্টপেজ। সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত টোটো গাড়িতে চেপে সোজা পলাশী যাওয়া যায় । টোটোটি বাঁ দিকের পথ ধরে চলে গেল ভাগীরথীর তীরে রামনগর নদীঘাট । পলাশীর সেই আম্রকানন আর নেই । গাছ কেটে তৈরি করা হয়েছে ফসলের খেত। সেখানে ফলে তিল, পাটসহ নানা ফসল ।
সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কোনো চিহ্নই আর অবশিষ্ট নেই । রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন ছবিতে প্রদশি’ত এই স্মৃতিস্তম্ভ । পলাশী যুদ্ধের স্মৃতিবাহী মনুমেন্ট। ১৫ মিটার উঁচু স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লেখা: ‘ব্যাটল ফিল্ড অব পলাশী, জুন ২৩, ১৭৫৭’। এ স্তম্ভ ইংরেজরা তৈরি করেছে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়ের স্মারক হিসেবে । এটি এখন দেশবাসীর কাছে ‘বিশ্বাসঘাতকতার স্তম্ভ’। পলাশী যুদ্ধের ২৫০ বছর পূর্তিতে এই স্মৃতিস্তম্ভের পাশে ছোট্ট আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয় । তাতে লেখা: ‘পরদেশগ্রাসীদের বিজয়স্তম্ভ নয়; সিরাজ, মীর মদন, মোহনলালের নাম হোক অক্ষয় ।’ এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান পিপলস ফোরাম ।
একটু দূরে স্মৃতিস্তম্ভে ঢোকার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে আছে নবাব সিরাজের আবক্ষ মূর্তি । এই মূর্তির নিচে লেখা ‘বিদেশী বেনিয়া বশ্যতা বিরোধী জোহাদি নায়ক সিরাজদৌল্লা’ । মনুমেন্টটির চারদিকে অযত্নের ছাপ। চারদিকে জঙ্গল জন্মেছে । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে এই স্মৃতিস্তম্ভ ।
স্মৃতিস্তম্ভের কাছের চায়ের দোকানদার অশোক বাজোয়াল বললেন, এই জায়গায় একসময় প্রচুর আমগাছ ছিল । রানি ভবানীর আমবাগান ছিল এটি । এখন রাস্তা হয়েছে । একটু দূরে চিনিকল হয়েছে ।
ওই যুদ্ধে ইংরেজ সেনাদের মোকাবিলা করার জন্য কামানের গোলায় আগুন দিতে গিয়ে কামান ফেটে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন নবাব সিরাজের সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মীর মদন । স্মৃতিস্তম্ভের পেছনের পথ ধরে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে গেলে মীর মদনের সমাধিস্থল । চারদিক প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হলেও সমাধি ঢেকে আছে জঙ্গলে । এখানে সমাধিস্থ করা হয় নবাবের আরও দুই বীর কমান্ডার বাহাদুর আলী খান এবং ক্যাপ্টেন নৌয়ে সিং হাজরাকে । বন্দুকধারী ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন বাহাদুর আলী খান। আর গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন নৌয়ে সিং হাজরা । যুদ্ধের পরপরই এখানে গোপনে তাঁদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল ।
সমাধিস্থলে যাওয়ার কোনো পাকা রাস্তা নেই । পাটখেতের আল ধরে যেতে হয় । স্থানীয় চাষি বিশ্বনাথ মণ্ডল বললেন, পলাশী স্মৃতিস্তম্ভ থেকে এই এক কিলোমিটার কাঁচা পথকে পাকা করে রাস্তার দুই ধারে আলো দিলে পর্যটকেরা এখানে সহজভাবে আসতে পারতেন । কারণ, বর্ষাকালে জমির আলে কাদা জমে যায় । হাঁটা দুষ্কর হয়ে পড়ে । ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য হেরে যায় নবাব বাহিনী । এই প্রহসনের যুদ্ধ বাংলায় কোম্পানি শাসনের পথ সুগম করে দেয় । যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে সিরাজ ফিরে যান মুর্শিদাবাদে । তারপর বিশ্বাসী খোঁজাকে নিয়ে তিনি নৌকাযোগে রাজমহলে যাওয়ার জন্য উঠে পড়েন নৌকায় । সঙ্গে স্ত্রী লুৎফা বেগম এবং চার বছরের কন্যা উম্মে জহুরা । কিন্তু দানশা ফকিরের চক্রান্তে তিনি ভগবানগোলায় ধরা পড়েন । তারপর মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিম সিরাজকে বেঁধে নিয়ে আসেন মুর্শিদাবাদে । ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই মীর জাফরের পুত্র মিরন মোহাম্মদী বেগকে দিয়ে হত্যা করান সিরাজকে । অবসান হয় একটি যুগের ।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ১৭ই জুন ২০১৭ইং সংখ্যার সৌজন্যে প্রাপ্ত, লিখেছেনঃ অমর সাহা ।