কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

কাঠামোপুজো হলেও জৌলুস হারানোর আশঙ্কা বনেদি বাড়ির

June 24, 2020 | 3 min read

২৬৩ বছরের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে শোভাবাজার রাজবাড়িতে। করোনার রক্তচক্ষু সত্ত্বেও এদিন এই বনেদি বাড়িতে যথারীতি অনুষ্ঠিত হল দুর্গাপ্রতিমার কাঠামোপুজো, অবশ্যই সামাজিক দূরত্বের শর্ত মেনে।

১৭৫৭ সালে বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমা বানানোর জন্য কৃষ্ণনগর থেকে দু’ঘর কুম্ভকার আনিয়েছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব। কলকাতায় ঘরবসত বানানোর জন্য তাদের জমিও দিয়েছিলেন। সেই পাড়াই এখন কুমোরটুলি। তখন থেকেই শোভাবাজার রাজবাড়িতে চল রথযাত্রার দিন প্রতিমার কাঠামোপুজোর। এদিন অবশ্য রাজবাড়িতে ভিড় ছিল অনেক কম। পরিবারের অন্যতম সদস্য সৌমিতমোহন দেবের কথায়, ‘এ বার স্বভাবতই পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা অনেকেই আসেননি। যে আত্মীয়স্বজনরা যারা দূরে থাকেন, তাঁরাও আসতে পারেননি। সমস্ত প্রথা আর সামাজিক দূরত্বের শর্ত মেনে এ বারও কাঠামো পুজো হয়েছে।’

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা ধরনের বিধিনিষেধের প্রভাব পড়তে চলেছে কলকাতা বহু প্রাচীন বনেদি বাড়ির পুজোর উপরে। বেশির ভাগ পুজোর খরচই জ্ঞাতিরা মিলে ভাগ করে বহন করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দায় অনেকেই কিছুটা নড়বড়ে হয়েছেন। তার প্রভাবে অনেকটাই জৌলুস হারাতে চলেছে পুজোগুলো। সৌমিত অবশ্য খরচ নিয়ে অতটা চিন্তিত নন। তিনি বলছেন, ‘আমাদের পুজো পরিচালনা করে অছি পরিষদ। কাজেই অর্থনৈতিক সমস্যা নেই। রয়েছে শুধুই সামাজিক সমস্যা।’

এদিন কাঠামোপুজো হয়েছে শিবকৃষ্ণ দাঁ লেনের দাঁ পরিবারেও। এই পরিবারের সদস্য সুভাষ দাঁ বলছেন, ‘আমাদের বাড়ির পুজো এ বার ১৮১ বছরে পা দিল। এদিন ছিল আমাদের জোড়া পার্বণ— একদিকে কাঠামো পুজো, অন্য দিকে পারিবারিক ব্যবসার হালখাতা পুজো, যা এ বার পয়লা বৈশাখে করা যায়নি। তবে সবই হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বা মাস্ক পরার মতো শর্ত মেনেই। লোকজনও ছিলেন কম। আমার তো মনে হয়, পুজোর দিনগুলিতেও এগুলো মাথায় রেখেই এগোতে হবে।’ কলকাতার অন্যতম নামী পুজোর মধ্যে রয়েছে জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ি। এই পরিবারের পক্ষ থেকে সুপ্রিয় হালদার বলছেন, ‘প্রতিবার আমাদের প্রতিমা তুলতে অন্তত ৮০ জন লোক লাগে। এ বার সামাজিক দূরত্বের জন্য সেটা করা সম্ভব হবে না। কাজেই প্রতিমার মাপ কমাতে হবে। অতিথি-অভ্যাগতদের কাউকেই এ বার আমরা নিমন্ত্রণ করতে পারব না। শুধু পরিবারের লোকজন থাকবেন।’

কাঠামোপুজো হলেও জৌলুস হারানোর আশঙ্কা বনেদি বাড়ির

নিয়োগী বাড়ি বললেই জলপাইগুড়ি শহরের কামারপাড়ার সাবেকি ঘরানার বাড়িটির ঠিকানা দেখিয়ে দেবে যে কেউ। বর্তমানে একসঙ্গে ১২টি পরিবারের বাস। আদতে ঢাকার মানিকগঞ্জের পাটগ্রামের জমিদার বংশ। দেশভাগের পর চলে আসে কলকাতায়। পরবর্তীতে পরিবারের একাধিক সদস্য কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। পুজো উপলক্ষে প্রতি বছরই পরিবারের তরফে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। একসময়ে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করা হত। এখন অবশ্য কেতাদুরস্ত কায়দায় পত্রিকা প্রকাশ হয়। আগে পত্রিকার নাম ছিল ‘ঘরোয়া’। এখন ‘জ্যোতি’।

পুজো যে জৌলুস হারাবে, সে বিষয়ে একরকম নিশ্চিত ভবানীপুর মল্লিকবাড়ির সদস্য প্রমিতা মল্লিকও। তিনি বলছেন, ‘এখনও পুজো নিয়ে পারিবারিক কোনও আলোচনা হয়নি। তবে খরচের বিষয়ে এ বছর যে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। দেখা যাক। হাতে এখনও সময় আছে।’ কুমোরটুলির কবিরাজবাড়ির কর্তা বাদল সেন রাঁচিতে কর্মরত ভাই পার্থকে নিয়মিত ফোন করছেন। বলছেন, ‘আমি জানি না, আমাদের সব জ্ঞাতিরা মিলে এবার অন্য বারের মতোই পুজোয় অবদান রাখতে পারবেন কি না। সেক্ষেত্রে খরচ তো কমাতেই হবে।’ ১৮৪০ সাল থেকে এই বাড়িতে দুর্গাপুজোর চল। এমন অস্তিত্ব সঙ্কটে কখনও পড়তে হয়েছে বলে মনে করতে পারেন না ৭৩ বছরের বাদল।

একই রকম আশঙ্কায় ভুগছেন দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির গৃহিণী বাণী মিত্র। পুজোর এখনও কোনও ব্যবস্থাই হয়নি। জ্ঞাতিদের বেশির ভাগই চাকরি করতে রাজ্য বা দেশের বাইরে। সবাই ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারবেন তো? বাণী বলছেন, ‘পলাশির যুদ্ধের পাঁচ বছর পর থেকে এই বাড়ির পুজো শুরু হয় বলে শুনেছি। এত পুরোনো পুজো, কিন্তু এ বার সবটাই অনিশ্চিত। আমি জানি না, শেষ পর্যন্ত প্রতিমা গড়ে পুজো করা যাবে, নাকি কাঠামো আর ঘট রেখে পুজো সারতে হবে।’ আর পুজোর উপাচার? বাণী বলছেন, ‘আমাদের প্রতিমার একটা নির্দিষ্ট মাপ আছে। প্রতিমা গড়লে ওই মাপ বজায় রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে অন্য জায়গায় খরচ কমাতে হবে।’

অনেক সাধারণ বাড়ির পুজোও এ বার একই রকম অস্তিত্ব সঙ্কটে। প্রায় ৪০ বছর আগে আরামবাগ থেকে হরিশ পার্ক অঞ্চলে চলে আসেন সঞ্জীব ভট্টাচার্যর বাবা। বছর দশেক আগে বাড়িতেই দুর্গাপুজো শুরু করেছেন সঞ্জীব। বলছেন, ‘করোনার পর আমার বেতন ২৫ শতাংশ কমে গেছে। আমি তখনই বাড়িতে বলে দিয়েছি, এ বছর পারলে ঘটপুজো করে নিতে। সব স্বাভাবিক হলে ফের ঘটা করে পুজো হবে। মা চাইছেন ছোট হলেও প্রতিমাপুজোই করতে। খুবই সামান্য ভাবে পুজো হবে।’

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#durga puja, #kathamo puja, #Bengali customary ritual

আরো দেখুন