ইন্দো- চীনে গলছে পারদ তবুও সীমান্তে প্রস্তুতি

সেনারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরবেন বলে যখন ভারতীয় সেনা বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, তখনই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চীন বাঙ্কার বানাচ্ছে।

June 24, 2020 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

একদিকে ভারত-চীন পরস্পর ‘ডিসএনগেজমেন্ট’-এ রাজি হয়েছে, অন্য দিকে সীমান্তে চলছে সাজ সাজ রব। সেনারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরবেন বলে যখন ভারতীয় সেনা বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, তখনই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চীন বাঙ্কার বানাচ্ছে। ভারত ট্যাঙ্ক আনাচ্ছে। কাজেই বরফ গলছে মনে হলেও, তা খুব ধীরে।

মঙ্গলবার সেনা সূত্রে দাবি করা হয়েছে, গলওয়ানের রক্তক্ষয়ী সেনা সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পরে টানা সাত দিন ‘স্ট্যান্ড অফ’-এর পরে অবশেষে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যেতে রাজি হয়েছে চীন সেনা৷ কী ভাবে হবে চীনা সেনার সরে যাওয়া বা ‘ডিসএনগেজমেন্ট, তা স্থির করার জন্য দু’দেশের সেনা আধিকারিকদের আলোচনা, মঙ্গলবারের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে ভারতীয় সেনার তরফে৷ ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পূর্ব লাদাখের চুশুল এলাকার মলডো অঞ্চলে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ইতিবাচক ও গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে, যেখানে পূর্ব লাদাখের সংঘর্ষের এলাকাগুলি থেকে সেনার ডিসএনগেজমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷’ চীনের বিদেশমন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, ভারত ও চীন দু’দেশ নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলের উত্তেজনা প্রশমনের কাজ করবে৷

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এর আগেও ভারতের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে পূর্ব লাদাখের বিস্তীর্ণ অংশে মোতায়েন থাকা নিজেদের বাহিনী ফেরত নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে চীনা সেনা৷ কিন্তু কথা রাখেনি।

কতটা সম্ভাবনা রয়েছে চীনের প্রতিশ্রুতি রক্ষার ? প্রাক্তন সেনা কর্তারা কিন্তু চীনকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না৷ তাঁদের সাফ কথা, ভুললে চলবে না প্রতিশ্রুতিতে৷ যতক্ষণ না এই প্রতিশ্রুতি পালন করছে চীন, ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্ত সতর্ক থাকতে হবে ভারতীয় সেনাকে৷

মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে প্রাক্তন উপসেনা প্রধান ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের বর্তমান সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা বলেন, ‘শুধু গলওয়ানের বর্তমান অভিজ্ঞতা থেকে নয়, চীনকে চিনতে হবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকেও৷ আমরা ভুলিনি, ডোকলামের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল৷ ওখানে ৭২ দিন ধরে স্ট্যান্ড অফ বহাল থাকার পরে নিজেদের সেনার ডিসএনগেজমেন্ট করতে চীন বহুদিন সময় লাগিয়ে দিয়েছিল৷ এই কারণেই এ বারেও আমাদের সেনাকে চূড়ান্ত সতর্ক থাকতে হবে৷ আমি নিশ্চিত, ভারতীয় সেনা সতর্ক রয়েছে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে৷’ তাঁর মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবার চীনের উপরে রয়েছে প্রবল চাপ৷ তিনি মনে করছেন, ‘ চীন ভাবেনি ভারতীয় সেনা এই ভাবে মোক্ষম জবাব দেবে৷ ওরা ভারতের প্রতিক্রিয়া পেয়ে গিয়েছে, তারপরেই নিজেদের অবস্থান বদলের আভাস দিয়েছে৷ তা না হলে ওরা ১১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ধরে আমাদের সেনা কর্তার সঙ্গে বৈঠক করত না৷ এর বাইরে চীনের উপরে আছে আন্তর্জাতিক চাপ৷ চীনের তরফে তাদের হতাহতের সংখ্যা স্বীকার করা না হলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ওদের৷ এটাও ওদের চাপে রেখেছে সার্বিক ভাবে৷’

এ সবের মাঝেই সিমেন্টের তৈরি ‘হলো ব্রিক’ বা ফাঁপা ইট দিয়ে পূর্ব লাদাখে ভারতীয় ভূখণ্ডের ভিতরে ও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার চারধারে গোটা পঞ্চাশেক ছোট-বড় বাঙ্কার তৈরি করে ফেলেছে চীনা সেনা৷ ১৫০০০ ফুট উঁচুতে লাদাখের অত্যন্ত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে পরিবহণ সমস্যার কথা মাথায় রেখেই বাঙ্কার তৈরির জন্য হাল্কা ওজনের ‘হলো ব্রিক’ এনেছে চীন৷

ইন্দো- চীনে গলছে পারদ তবুও সীমান্তে প্রস্তুতি

এই ইটের বৈশিষ্ট্য হল প্রবল ঠান্ডায় তুলনামূলকভাবে পরিবেশ গরম রাখতে সাহায্য করে৷ ফলে বাঙ্কারের ভিতর গরম থাকবে। এর পাশাপাশি সাধারণ ইটের তুলনায় গুলি ও বোমার আঘাত সইতে পারার ক্ষমতাও ‘হলো ব্রিক’র অনেক বেশি, জানাচ্ছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ভারতীয় সেনার প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য৷ তাঁর কথায়, ‘সেনার পরিভাষায় একে বলা হয় ‘হলো ব্রিক্‌স পিল বক্সেস’। এটা বহন করা সহজ, সহ্য ক্ষমতাও অনেক বেশি৷ ফলে এই ইট দিয়ে তৈরি বাঙ্কারে গুলি-বোমার প্রভাব কম অনুভূত হয়৷ উঁচু পার্বত্য এলাকায় এই ইটের কার্যকারিতা বেশি৷’

ভারতীয় সেনার অপর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল রামেশ্বর রায় বলেন, ‘আমার মনে হয়, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে থাকার পরিকল্পনা করেই ‘হলো ব্রিক’ প্রযুক্তির ইট ব্যবহার করে বাঙ্কার তৈরি করেছে চীন৷ ওদের মূল লক্ষ্য থাকবে দরবুক-ডিবিও পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তার উপরে সারা বছর লাগাতার নজরদারি চালানো৷ ওই রাস্তা দিয়ে ভারতীয় সেনা কখন কী মুভমেন্ট করছে সেটাই পর্যবেক্ষণ করতে চাইছে ওরা৷ সেই কারণেই ওরা চাইছে পিপি১৪-র আশেপাশের পুরো এলাকা নিজেদের দখলে রাখতে এবং এই এলাকায় ভারতীয় সেনার টহলদারি চিরতরে বন্ধ করতে৷’

চীন যখন পাকাপাকি ভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে থেকে যাওয়ার কথা ভাবছে, তখন ভারতও পাল্টা প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই সেখানে ভারী ভারী ট্যাঙ্ক মোতায়েন করেছে নয়াদিল্লি। ১৯৬২ সালে যুদ্ধের পরে এই প্রথম এত ভারী ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা হল পূর্ব লাদাখে চীনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে৷ এর পাশাপাশি পূর্ব লাদাখের বিস্তীর্ণ অংশে মোতায়েন করা হচ্ছে উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে লড়াইয়ে পারদর্শী আইটিবিপির ৩০ কোম্পানি জওয়ান৷

এর মধ্যেই, মঙ্গলবার দু’দিনের সফরে লেহ পৌঁছেছেন সেনা প্রধান এম এম নারাভানে৷ গলওয়ানের সেনা সংঘর্ষে যাঁরা আহত হয়েছিলেন, লেহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সেই সব সেনা জওয়ানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সেনা প্রধান৷ পরে তিনি সাক্ষাৎ করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাংসদের সঙ্গে৷ সেনা সূত্রের খবর, আজ বুধবার লাদাখের কয়েকটি ফরোয়ার্ড পোস্ট পরিদর্শন করবেন সেনা প্রধান৷

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen