বুলবুল – পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর টিকে থাকার লড়াইয়ের গল্প
বড় বড় মহলে কান পাতলেই গোপন অনেক গাঁথা শোনা যায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যায় অবর্ণনীয় নানা অত্যাচার। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই কত গভীর ক্ষত লুকিয়ে থাকে রংচঙে পোশাক, গয়না আর হাসিগুলির পেছনে। বুলবুল এমনই এক মহলের কথা আমাদের বলে। অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত এবং অন্বিতা দত্তের লেখা ও পরিচালিত এই গল্প একটি ছোট্ট মেয়ে বুলবুলের। দস্যি এই মেয়ে বাগ মানে না। বিয়ের দিনেও আমি বাগানে গাছে চড়ে বসে থাকে। তাই তো বাগদানের আগে তার পিসি পায়ে বিছে পরিয়ে দেন যাতে মেয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে না বেড়াতে পারে।
বুলবুলের (তৃপ্তি দিমরি) বিয়ে হয় তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ইন্দ্রনীলের (রাহুল বসু) সাথে। এদিকে বুলবুলের সব সময়ের সঙ্গী হয়ে ওঠে তারই সমবয়সী দেওর সত্য (অবিনাশ তিওয়ারি)। আর বিষফোঁড়া হয়ে থাকে ইন্দ্রনীলের মানসিক বিকারগ্রস্ত যমজ ভাই মহেন্দ্র, যার স্ত্রী বিনোদিনী (পাওলি দাম) ইন্দ্রনীলের শয্যাসঙ্গিনীও বটে। রবীন্দ্রনাথ পারেননি কিন্তু অন্বিতা মহেন্দ্র-বিনোদিনীর মিলন ঘটালেন। ‘সুখের’ সংসারে গোল বাঁধে যখন সত্যকে পড়াশোনা করতে লন্ডন পাঠানো হয়। এখানেই কাহিনীর সূত্রপাত, যার ইতি ঘটে ২০ বছর বাদে।
বুলবুলের গল্প যেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারী বিদ্বেষের এক জ্বলন্ত আখ্যান। গল্পের পরতে পরতে পুরুষের অযাচিত অধিকার ফলানোর ভার বইতে হয় মহিলাদের। বিনা বাক্যব্যায়ে। স্বামী হোক বা দেওর, নারীর স্থান যে চিরকাল পুরুষের পদতলে এই ভাবনাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। দৈবিক যোগে ঘটে যায় পালাবদল। সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। এক জায়গায় বিনোদিনীকে দুঃখ প্রকাশ করতে শোনা যায় (নাকি সেটি ছিল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ) স্বামী পাগল তো কি হয়েছে, বড় মহলে থাকবে, গয়না পাবে, রেশমের কাপড় পরবে – যেন নারীর ভবিতব্য শুধুই অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে স্বামীর সেবা করা।
বুলবুল ছবির বল অভিনয় গুণে। নাম ভূমিকায় তৃপ্তির অভিনয় এক কথায় অসাধারণ। চারুলতা যেমন অমলকে হারিয়ে দিক্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েছিলেন, তৃপ্তিও সেই অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন পেশাদারিত্বের সাথে। নিষ্পাপ বালিকা বধূ থেকে পরিপক্ক গৃহকর্ত্রী হয়ে ওঠার মধ্যে যে সূক্ষ্ণ পরিবর্তন, তা ব্যক্ত করেছেন অপূর্ব। সত্য-র ভূমিকায় অবিনাশও ভাল। চরিত্রের দিশাহারা ভাব ভালই উত্থাপিত করেছেন। ডাক্তারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ছাপ রেখেছেন দক্ষতার।
ছবির মূল আকর্ষণ অবশ্যই বিনোদিনীর চরিত্রে পাওলি দাম। মানসিক প্রতিবন্ধী স্বামী, সহবাসের অংশীদার ভাসুর, অকাল বৈধব্য, একরাশ না পাওয়ার বেদনা, বয়সে ছোট কিন্তু সম্পর্কে বড় জায়ের প্রতি ঈর্ষা – প্রত্যেকটি অনুভূতি সাবলীলভাবে চরিত্রায়িত করেছেন তিনি। পাশাপাশি, দ্বৈত চরিত্রে মন ছুঁয়ে যান রাহুল বসু। নিপাট ভদ্রলোক থেকে ঈর্ষাপরায়ণ স্বামী, নৃশংস, অত্যাচারী পুরুষ থেকে কামুক, মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই – ফুটিয়ে তুলেছেন নানা আঙ্গিক।
বুলবুল ছবিটি মনোগ্রাহী করে তোলার পেছনে যাদের অবদান, তাদের মধ্যে চিত্রগ্রাহক সিদ্ধার্থ দেওয়ান, অন্দরসজ্জায় মিনাল আগারওয়াল, পরিস্ফুটনে মকরন্দ সুরতে, পোশাক বিন্যাসে, ভিরা কাপুর এবং আবহ সঙ্গীত পরিচালক অমিত ত্রিবেদীর নাম করতেই হয়। লাল আভায় সজ্জিত এক একটি ফ্রেম যেন পূর্বাভাস দেয় মহাজাগতিক কোনো ইঙ্গিতের। লাল – একদিকে যেমন প্রেমের রঙ, এটি আবার রক্তের রঙও বটে। ধূসর মন্তাজে আবার মনের গভীরতম পাশবিক অনুভূতির কথা মনে পড়ে যায়।
ঠাকুমার ঝুলিতে আমরা শাকচুন্নির গল্প পড়েছি। জেনেছি সুয়োরানী-দুয়োরানীর কথা। সেই একই গল্প অন্য ধাঁচে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন অন্বিতা। ঠিক-ভুলের মাপদণ্ডটা কেমন গুলিয়ে দিলেন। কে ভিলেন? কে হিরো? ঠিক কোনটা? বেঠিকের হিসেবও বা কে করবে? বিচার বরং দেবী ভবতারিণীই করুন।
রেটিং – ৪/৫ স্টার