নস্টালজিয়া আর অভিনয়ের রসায়নে বাজিমাত ফেলুদার, জমে উঠল গোয়েন্দাগিরি
অগ্নিভ নিয়োগী
ফেলুদা। দার্জিলিং। নস্টালজিয়া প্রিয় বাঙালির ইমোশন উস্কে দিতে এই দুটো কথা বোধহয় যথেষ্ট। ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া, আর অলস দুপুরে মানিকবাবুর লিখে যাওয়া অমর গোয়েন্দার বইয়ের পাতা ওল্টানোর স্মৃতি আজও মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল কমবেশি সবারই। সেই প্রিয় চরিত্রের রাজকীয় প্রত্যাবর্তন যে সাড়া ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য।
আসলে ফেলুদা সাব্জেক্টটাই খুব জটিল। একদিকে সৌমিত্র-সন্তোষ-সিদ্ধার্থ ত্রয়ীর গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে পান থেকে চুন খসলেই রে রে করে ট্রোল করতে আসা দর্শক – ফেলুদাকে নিয়ে কাজ করলে জনতার মন রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। বলতে দ্বিধা নেই, সৃজিত মুখোপাধ্যায় সেই পরীক্ষায় লেটার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
মূল কাহিনীতে বিরাট হেরফের না করেও যে পর্দায় মনোগ্রাহী গল্প বলা যায়, তা সৃজিত প্রমাণ করেছিলেন ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ সিরিজে। সেই যাত্রায় ফেলুদা ফেরত এলেও প্রিয় গোয়েন্দার প্রত্যাবর্তন হতে পড়েছিল বাধা। সেইসব কাটিয়ে স্বমহিমায় বাঙালির থ্রি মাস্কেটিয়ার্স হাজির নতুন কলেবরে, নতুন ঠিকানায়। হইচই এর নতুন সিরিজ ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির’ প্রথম সিজনে বাজিমাত করেছেন পরিচালক ও কলাকুশলীরা।
দার্জিলিঙকে জমজমাট করে তুলতে পরিচালককে সঙ্গত যারা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় অভিনেতাদের। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপে’ ফেলুদা-রূপী টোটা রায়চৌধুরীর যতটুকু জড়তা ছিল তা অনায়াসে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি এই সিরিজে। মূল তিন চরিত্রের মধ্যেকার রসায়ন অনেক পরিণত, কম আড়ষ্ট। বিশেষত তোপসের চরিত্রে কল্পন এবারে অনেক বেশি প্রাণবন্ত।
আর অনির্বাণ চক্রবর্তীর কথা কীই বা বলব। ছোটবেলায় বইটা পড়ার সময় যেমন কল্পনা করেছিলাম, ঠিক খাপে খাপ মিলে গেছে তাঁর চরিত্রায়ন। একেনবাবুর ছায়া কাটিয়ে জটায়ুর ভূমিকায় কেল্লা ফতে করেছেন তিনি। বিশেষ করে যে দৃশ্যগুলিতে তাঁকে পুলক ঘোষালের ছবিতে অভিনয় করতে হয়, সেগুলো এক কথায় অনবদ্য। আর পুলক ঘোষালের কথা উঠলোই যখন, সৃজিত মুখুজ্জের প্রশংসা না করলেই নয়। রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় just ফাটাফাটি। এছাড়া, রাজেন রায়নার ভূমিকায় সাহেব ভট্টাচার্য, মহাদেব ভার্মার চরিত্রে সুব্রত দত্ত এবং বিরূপাক্ষ মজুমদার হিসেবে বরুণ চন্দ নিজেদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন যথাযথভাবে।
সত্যজিৎ রায়ের বই পড়ার অন্যতম আকর্ষণ ছিল শব্দের মাধ্যমে এক নতুন জায়গা চেনা। তাঁর বর্ণনার সাথে নিজের কল্পনাকে মিশিয়ে এক মায়াবী স্বপ্নের জাল বোনা। চিত্রগ্রাহক রম্যদীপ সাহার সাথে মিলে সৃজিত মুখোপাধ্যায় আমাদের সেই কল্পনাকে বাস্তবের রূপ দিয়েছেন। এক একটি দৃশ্য যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা শেষ এপিসোড অবধি ধরে রেখেছে রহস্যের মোচড়। পুরো গল্পটা প্রায় মুখস্ত জানা সত্ত্বেও এক মুহূর্তের জন্য skip বা forward করার ইচ্ছে মনে জাগেনি।
খেদ একটাই, আবহসঙ্গীতটা যেন একটু কম spontaneous ছিল। কিছু কিছু দৃশ্যে মনে হচ্ছিল, এখানে আবহটা আরেকটু জমলে ভালো হত। সত্যজিৎবাবুর তৈরি ফেলুদা থিম আরেকটু ব্যবহার করলে মন্দ হত না। আর একদম প্রথম দৃশ্যে ফেলুদার বাড়ির অন্দরসজ্জাটাও কেমন ম্যাড়মেড়ে লেগেছে। হয়তো অভ্যাসের দোষ, এতদিন একরকম বাড়ি দেখে অভ্যস্ত চোখ ঠিক মেলাতে পারছিল না এই নতুন সেট।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্পের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, শেষ হইয়াও হইল না শেষ। এই সিরিজও তেমনই। রহস্যের সমাধান হয়ে গেল, এন্ড ক্রেডিট রোল শুরু হল, তবুও মন কেমন রয়ে গেল। ইসসস, দার্জলিং থেকে তো গ্যাংটক খুব দূরে নয়। ফেলুদা চাইলেই তো ঘুরে আসতে পারে। কিংবা লখনৌ, অথবা উত্তরবঙ্গের জঙ্গলেই? বড়দিনে ‘অবিশ্যি’ ফেলুদা যাচ্ছে পুরী। তবে, দার্জিলিঙ যা বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিল, এরপর থোড় বড়ি খাড়া দিয়ে মন ভরবে তো?