শেরদিল – প্রকৃতির জয়গানে নতুন সৃজিতের আস্বাদ পেল দর্শক
অগ্নিভ নিয়োগী
যখন কিছুই ছিল না, তখন জঙ্গল ছিল। যখন কিছুই থাকবে না, তখনও জঙ্গলই থাকবে।
শেরদিল ছবির ক্লাইম্যাক্স যখন আসন্ন, তার কিছু আগেই এক চরিত্রের মুখে এই সংলাপ শোনা যায়। আপাত সাধারণ একটা লাইন যে কতটা অমোঘ হতে পারে তা হয়তো পরিচালক নিজেই জানেন না। কিছুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড ডমিনিয়ন ছবিটি। মানব সভ্যতার উন্নয়নের ঠেলায় কতটা বিপন্ন এই পৃথিবীর জীববৈচিত্র, সেটাই মূল বার্তা ছিল সেই ছবির। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেই একই বার্তা দিল শেরদিল। যদিও এই ছবির ব্যাপ্তি আরও বিশাল।
কিছু বছর আগে উত্তরপ্রদেশের পিলভিটে ঘটে গেছিল এক আশ্চর্য ঘটনা, যা দেশজুড়ে সৃষ্টি করেছিল বিতর্কের ঝড়। দারিদ্রের চরমে ভুগতে থাকা একদল গ্রামবাসী তাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের বাঘের খাদ্য হিসেবে পাঠিয়ে দিত জঙ্গলে। এরপর বাঘের হাতে নিহত সেই গ্রামবাসীদের মৃতদেহ ক্ষেতে ফেলে রেখে সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইত বাসিন্দারা। সেই ঘটনারই কাল্পনিক পুনর্নির্মাণ করলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
সৃজিত মুখোপাধ্যায় নামটা শুনলেই আম বাঙালির যে ছবিগুলির কথা মনে পড়ে সেগুলি হল বাইশে শ্রাবণ, চতুষ্কোণ কিংবা জাতিস্মর। টানটান থ্রিলার, মার্কামারা ডায়লগ, লার্জার দ্যান লাইফ ক্যানভাসে চিত্রিত অবিস্মরণীয় এক একটা কাহিনী। শেরদিল সৃজিতের অন্যান্য ছবি থেকে একদমই ভিন্ন। এই ছবিতে টানটান উত্তেজনা নেই, গুরুগম্ভীর রহস্য নেই। নেই কলকাতা শহরের অক্ষরেখা কিংবা অলিগলির গল্পরাশি। শেরদিল জুড়ে আছে শুধু একরাশ প্রশান্তি আর চোখ-কানের আরাম।
যদিও এই গল্পের প্রেক্ষাপট উত্তরপ্রদেশের পিলভিট, ছবির শুটিং হয়েছে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের জঙ্গলে। সবুজের এমন সমাহার আর বন্যপ্রাণীর এই বৈচিত্র্য মূলধারার ছবিতে সচরাচর দেখা যায় না। ড্রোন শট তো বটেই, জঙ্গলের ভেতরের ক্লোজ শট গুলিও মুগ্ধ করে। তিয়াস সেনের কাজ অবর্ণনীয়। আর জঙ্গলের এই ভীষণ সুন্দর রূপের মাধুর্য আরও প্রস্ফুটিত হয় আবহ সঙ্গীতের মাধ্যমে। অদীপ সিংহ মাঙ্কি এবং অনিন্দিত রায়ের শব্দ পরিকল্পনা প্রশংসার দাবি রাখে।
শেরদিল ছবি জুড়ে যেমন অদৃশ্য উপস্থিতি আছে বাঘ বাহাদুরের, সেই একই দাপটের সঙ্গে প্রত্যেকটি দৃশ্য মাতিয়েছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি। ছবির বেশিরভাগ জুড়ে যেহেতু তিনি একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাই তার মুখাভিব্যক্তির ওপর দাঁড়িয়ে চিত্রনাট্যের বিরাট অংশ। সোজা ব্যাটে সহজেই ছক্কা হাঁকিয়েছেন পোড়খাওয়া এই অভিনেতা। তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় নজর কেড়েছেন সায়নী গুপ্তও। ছবির দ্বিতীয়ার্ধে পঙ্কজকে উপযুক্ত সঙ্গত দিয়েছেন নীরজ কবি।
শুধুই মানব সভ্যতার সাথে প্রকৃতির বিরোধের কথা বলে ক্ষান্ত থাকেননি সৃজিত। ছবির পরতে পরতে উঠে এসেছে দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। মাংস খাওয়া থেকে একটি বিশেষ দলের নেতাদের দেশের সব সমস্যার জন্য নেহরুকে দুষবার প্রবণতা, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার ক্ষণস্থায়ী জনপ্রিয়তা থেকে কৃতিত্ব নিতে নেতা-মন্ত্রীদের মুখিয়ে থাকার বদভ্যাস – আর দেশের চিরকালীন আমলাতন্ত্রের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কী নেই ছবিতে!
শুধু মাঝে মাঝে মনে হতে পারে, ছবিটা এবার গতি পেলে ভালো হত। সম্পাদনার টেবিলে আরেকটু কাটছাঁট করলে মন্দ হত না। আর কোনও কোনও দৃশ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্রে জর্জরিত গ্রামের প্রধানকে পরিপাটি করে কাচা, ইস্তিরি করা পাঞ্জাবি পরে থাকতে দেখেও চোখে ঠেকে। এছাড়া, ক্লাইম্যাক্সে বাঘের সাথে গঙ্গারামের দেখা হওয়ার দৃশ্যটা মনে ধরে না। বাঘের অত কাছে দাঁড়িয়ে দুই চরিত্র প্রায় তিন মিনিট নিজেদের মধ্যে কথা বলে গেল, এদিকে বাঘ বাবাজির হেলদোল নেই? আর গঙ্গারাম যখন বাঘের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে, তখন VFX ও কমজোরি লাগে।
তবে, এই ছোট না-ভালো লাগাগুলো এতটাই যৎসামান্য যে গোটা ছবির ব্যাপ্তি এতে মোটেও খাটো হয় না। বরং, আজকের অসহিষ্ণু সময়ে দাঁড়িয়ে এইরকম একটা শ্লেষাত্মক ছবি নির্মাণে বুকের পাটা লাগে। প্রায় ১২ বছর আগে দেশের মূল্যবৃদ্ধি সমস্যা যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল পিপলি লাইভ, শেরদিল ঠিক একইভাবে শিব ঠাকুরের আপন দেশ, আমাদের বর্তমান ভারতের খণ্ডচিত্র তুলে ধরে।