বিপ্লবী ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও ভবানী ভবন

স্বাধীনতার পরেই ওই বাড়ির নাম বদল নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠতে শুরু হয়েছিল। অবশেষে ১৯৬৯ সালে অ্যান্ডার্সন হাউসের নাম বদলে ভবানীভবন রাখা হয়

August 15, 2025 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

সৌভিক রাজ

কথায় বলে পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা! সেই পুলিশের সদরদপ্তরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্যের নাম। ওপার বাংলার ছেলে ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য। ছাত্রাবস্থায় তিনি বিপ্লবী দলে যোগ দেন।

১৯৩২ সালে বাংলার বিপ্লবীদের হাতে নাজেহাল হয়ে ব্রিটিশরা স্কটিশ সাহেব অ্যান্ডার্সনকে গভর্নর করে নিয়ে আসে। আয়ারল্যান্ডে বিভাজন নীতি প্রয়োগ করেই সিনফিন আন্দোলন দমন করার পর থেকেই ব্রিটিশদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন সাহেব। তাই তাকেই পরাধীন ভারতের বিপ্লব দমনের ভার দেওয়া হয়। বাংলার অত্যাচারী ও কুখ্যাত গভর্নর এই অ্যান্ডার্সন হত্যার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ভবানী ভট্টাচার্য কলকাতা ও ঢাকা থেকে দুজন সঙ্গী নিয়ে ১৯৩৪ সালের মে মাসে দার্জিলিং পৌঁছান। এই হত্যা পরিকল্পনায় ভবানীপ্রসাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের সুকুমার ঘোষ, উজ্জ্বলা মজুমদার (রক্ষিত রায়), রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মনোরঞ্জন ব্যানার্জী প্রমুখ। লেবং রেস কোর্স গ্রাউন্ডে তারা ৮ মে ১৯৩৪ তারিখে অ্যান্ডারসনকে গুলি করেন। ভবানী তাঁর ছোট ভাই দূর্গা প্রসাদকে বলে এসেছিলেন সব বিপ্লবী বই , গ্রন্থতালিকা পুড়িয়ে ফেলতে, তাঁর বন্ধু প্রবোধকে সব পত্রিকা দিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাড়িতে বাবা মাকে বলেছিলেন, ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় থাকবেন, তাই মেস দেখতে যাচ্ছেন। দু-দিন পরই ফিরে আসবেন! কিন্তু ফেরা হয়নি আর! দুদিন পরে তাঁদের বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, তল্লাশি করতে। সেই পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আইবি সুপার গ্র্যাসবি সাহেব। পুরো পরিবারের জিজ্ঞাসাবাদ চলে। হবে না সেবাড়ির মেজো ছেলে যে ছোটলাটকে গুলি করেছে।

১৯৩৪-এর ঐ দিন কেমন ছিল… দার্জিলিঙের লেবং-এ ঘোড়দৌড়ের মাঠ। অ্যান্ডার্সন আসছেন বিজয়ীদলকে পুরস্কার বিতরণ করতে। ভবানী ভট্টাচার্য (Bhabani Prasad Bhattacharya) এবং রবি ব্যানার্জি টিকিট কেটে মাঠের ভিতরে প্রবেশ করেন যথাসময়ে। তাঁদের আসন গ্রহণ করতে দেখেই, মনোরঞ্জন ব্যানার্জি এবং উজ্জ্বলা মজুমদার শিলিগুড়ি স্টেশনের দিকে রওনা দেন। পুরো ঘটনা এগোতে থাকে পরিকল্পনা মাফিক।

মাঠে শ্বেতাঙ্গ ও দেশী রাজা মহারাজাদের ভিড়, অতএব প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাও জোরালো, পুলিশ এবং সাদা পোশাকে গুপ্তচরে ভর্তি গোটা মাঠ। ঘোড়াদৌড়ের শেষ হল। অ্যান্ডার্সন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, পুরস্কার বিতরণ শুরু হবে। ভবানী ভট্টাচার্যও উঠে দাঁড়ালেন। দুজনের বেশ অনেকটাই দূরত্ব ছিল এবং তাঁর চারপাশে ছিল পুলিশ, গুপ্তচর, সাহেব আর মেমসাহেবের দল। ফলে সেখান থেকে এগোতে গেলেই তারা সন্দেহ করবেন। তাই ভবানীপ্রসাদ স্থির করলেন, ওইখান থেকেই সাহেবের দফারফা করবেন।

ভবানীপ্রসাদ, তাঁর রিভলভার থেকে সাহেবকে লক্ষ করে গুলি করলেন কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, গভর্নরের দেহরক্ষী তৎক্ষণাৎ গুলিবর্ষণ করলেন, লক্ষ্য ভবানীপ্রসাদ। গুলির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে ঢোলে পড়েন ভবানীপ্রসাদ। রবি ব্যানার্জী সাথে সাথে তাঁর রিভলভার থেকে গুলি করতে শুরু করেন। তাঁর গুলিতে বিদ্ধ হয়ে পড়েন গভর্নরের স্টেনো মিস থর্টন এবং এক শ্বেতাঙ্গ সার্জেন্ট। এরপরই রবি ব্যানার্জীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক দল দেহরক্ষী। ততক্ষণে তাঁর রিভলবারের গুলিও শেষ। গুরুতর আহত ভবানীপ্রসাদ এবং রবি ব্যানার্জীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিচারে সুকুমার ঘোষের ১৪ বছর কারাদন্ড হয় এবং দুঃখপ্রকাশ করায় অপরজনের শাস্তি অল্প হয়। কিন্তু ভবানীপ্রসাদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৩রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৫ সালে বাংলাদেশের রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ভবানীপ্রসাদকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

ইংরেজ শাসকের অ্যান্ডার্সনের নামে আলিপুরে অ্যান্ডার্সন হাউস গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশেরা। স্বাধীনতার পরেই ওই বাড়ির নাম বদল নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠতে শুরু হয়েছিল। অবশেষে ১৯৬৯ সালে অ্যান্ডার্সন হাউসের নাম বদলে ভবানীভবন রাখা হয়। যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্য পুলিশের সদর দপ্তর। এখানে এখন ভবানীপ্রসাদের মূর্তিও বসেছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen