বাংলা ভাষাকে জ্যান্ত রাখার কারিগর প্রমথ চৌধুরী
সৌভিক রাজ
একটি ভাষাকে জ্যান্ত রাখার জন্য হাজারও পরিবর্তনকে মেনে নিতে হয়। একদল রয়েছেন, যারা চিরাচরিত এই পরিবর্তনের কান্ডারি। আর আরেক দল পরিবর্তন দেখলেই রে রে করে ওঠেন। আজ যে বাংলা ভাষা জ্যান্ত রয়েছে তার অন্যতম নেপথ্য নায়ক হলেন প্রমথ চৌধুরী (Pramatha Chaudhuri)। আধুনিক বাংলা সাহিত্য প্রাচীন -মধ্য যুগের খোলস ত্যাগ করে চলিত ভাষায় নতুন রূপ পেয়েছিল তাঁর জন্যেই। বাংলা গদ্যের ভাষাকে চলিত ভাষার রূপ দেওয়ার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার নিজের লেখাতেই রয়েছে, যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ প্রাণ। আজ তার জন্মদিন। ১৮৬৮ সালে আজকের দিনে তার জন্ম হয়েছিল।
বীরবল ছদ্মনামটি ব্যবহার করতেন। প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র নামে একটি চলিত ভাষা ভিত্তিক মাসিকপত্র সম্পাদনা করতে, এর মাধ্যমেই তিনি বাংলা সাহিত্যে ‘বীরবলী-ঢং’-এর গদ্যরীতির প্রবর্তন করেন। তবে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল রবীন্দ্র সমকালে, সাহিত্য চর্চা করে এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হয়েও, তার গদ্য রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত ছিল। বাংলাগদ্যে এক অভিনব রীতি এনেছেন তিনি। উনিশ শতকে আলালের ঘরের দুলাল লিখছে ফেলেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র, কালী সিংহীও হুতোম প্যাঁচার নকশা লিখেছেন, বাংলা সাহিত্যে চলিত গদ্যের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই গদ্যের ভাষায় এবং রীতিতে সৌন্দর্যবোধের অভাব ছিল। সেটাই আনলেন প্রমথ চৌধুরী। সেই আলালী ভাষার উপর বিশ শতকে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে সুমার্জিত রূপ ও রীতি দান করেন প্রমথ চৌধুরী।
রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন-“তোমার গদ্যপ্রবন্ধ সবগুলিই পড়েছি। তোমার কবিতার যে গুণ তোমার গদ্যেও তাই দেখি – কোথাও ফাঁক নেই এবং শৈথিল্য নেই, একেবারে ঠাস বুনানী।” ১৯০৬-এ প্রকাশিত তেল, নুন, লকড়ি, বীরবলের হালখাতা, দু-ইয়ারকি, বীরবলের টিপ্পনী বোধকরি এগুলোর তুলনা আজও হয়না। এগুলোই বলে দেয় কত শক্তিশালী কলমের মালিক ছিলেন প্রমথ চৌধুরী।
বাংলা সাহিত্যে ফরাসী গদ্যের প্রসাদগুণ, সংযম ও বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতা তিনিই আমদানি করেছিলেন।
প্রবন্ধের রাজা ছিলেন তিনি, সাহিত্য, শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানান বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। সেগুলি মূলত ‘সবুজপত্রে’ প্রকাশিত হত। তার কথারকথা, সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা, আমাদের ভাষা সংকট, ইত্যাদিতে প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষার (Bengali Language) যুগোপযোগী কাঠামো নির্মাণের কথা বলে গিয়েছেন। তিনিই লিখতে পারেন, ভাষায় কৃত্রিম আর্টের কোন স্থান নেই। পরিহাসপ্রিয় উপভোগ্য বিষয় উঠে আসত তার লেখায়। আবার সাহিত্যে খেলা, সাহিত্যে চাবুক, খেয়াল খাতা, কাব্যে অশ্লীলতা, ইত্যাদি প্রবন্ধও জন্ম দিয়েছে তার কলম।
তার আত্মজীবনীভিত্তিক প্রবন্ধগ্রন্থ আত্মকথায় শৈশবকাল থেকে ইংল্যাণ্ড যাত্রার আগে পর্যন্ত বহু ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। সমকালীন দেশের বিচিত্র পটভূমি, বিশিষ্ট সামাজিক গণের পরিচয় অবশ্য এখানে খুব বেশি আসেনি। লেখার মধ্যে যে অসংলগ্নতা রয়েছে সে বিষয়ে সচেতন রয়েছেন তিনি। তাই ‘কৈফিয়ত’ অংশে বলেছেন-“আত্মকথা লিখতে আরম্ভ করি অতি দুঃসময়ে, রবীন্দ্রনাথ তখন একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত। পরে তিনি সে ফাঁড়া কাটিয়ে উঠলেন। তারপর ১৯৪১ সালে উপর্য্যুপরি আমার নানারকম দুর্ঘটনা ঘটতে লাগল।”
আজকের বিশ্লেষণ বলে, বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর মতো এত বুদ্ধিদীপ্ত যুগোপযুগী লেখন ভঙ্গি আর ছিলই না প্রায়। প্যারীচাঁদ, কালীপ্রসন্ন থেকে বাংলাগদ্যে আধুনিক চলিত রীতির প্রবর্তন হয়েছিল, তরণীবাহক হয়ে তা বয়ে নিয়ে গিয়েছেন প্রমথ চৌধুরীই।