আজকের দিনে পরমহংস হয়েছিলেন মনোবাঞ্ছার কল্পতরু, জানেন মাহাত্ম্য?
সৌভিক রাজ
আজ কল্পতরু উৎসব। কল্পতরু আদপে পরমহংসদেবের অবতারত্বের এক উপাখ্যান। প্রাণের ঠাকুর তাঁর ভক্তমাঝে আজকের দিনেই ধরা দিয়েছিলেন ‘কল্পতরু’ রূপে। রামকৃষ্ণদেবের শেষ লীলা এটি। সকলকে মনোবাঞ্ছা পূরণের আশীর্বাদ করে তিনি অভয় দান করেছিলেন।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব রোগাক্রান্ত, খুব অসুস্থ। মুখ থেকে রক্ত উঠছে, ডাক্তারের পরামর্শে ১৮৮৫-র শেষ লগ্নে ভক্তেরা ঠাকুরকে দক্ষিনেশ্বর থেকে শ্যামপুকুর বাটিতে নিয়ে এলেন। শেষ বারের মতো ঠাকুর ছেড়ে এলেন দক্ষিনেশ্বর। আর তাঁর দক্ষিণেশ্বরে ফেরা হয়নি। রোগ কমা তো দূরস্থ, ক্রমাগত বেশি মাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করলেন ঠাকুর। তাই ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল, শহরের ভিড় ও দূষণ থেকে দূরে কাশিপুরের বাগানবাড়িতে। এখানেই কেটেছে ঠাকুরের জীবনের শেষ ক’টি মাস।
যা আজ উদ্যানবাটি নামে পরিচিত এবং বর্তমানে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একটি শাখাকেন্দ্র। কাশীপুর উদ্যানবাটিটি আদপে ছিল বিশিষ্ট জমিদার রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাল লাল ঘোষের সম্পত্তি। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবেরর ভক্তগণ তার কাছ থেকে মাসিক ৮০ টাকা ভাড়ায় প্রথমে ছয় মাস ও পরে আরও তিন মাসের জন্য বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। উদ্যানবাটির মোট এলাকার আয়তন ছিল ১১ বিঘার কিছু বেশি। একটি দোতলা বাড়ি, বাগান এবং পুকুর নিয়ে উত্তর কলকাতার কাশীপুর অঞ্চলে অবস্থিত বাড়িটি। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ১৮৮৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর থেকে ১৮৮৬ সালের ১৬ই অগস্ট তাঁর প্রয়াণ পর্যন্ত কাশীপুর উদ্যানবাটিতে বাস করেছিলেন। এই মঠের বাগানে একটি আমগাছের তলায়(মতান্তরে খেজুর গাছ) দাঁড়িয়ে ১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি তিনি, তাঁর গৃহস্থ শিষ্যদের আশীর্বাদ করেছিলেন। এই ঘটনার স্মরণে প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি কল্পতরু উৎসব পালিত হয়।
এই উদ্যানবাটিতেই ঠাকুরকে দেখতে আসতেন বিখ্যাত চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার, রাজেন্দ্র লাল দত্ত প্রমুখ। ঠাকুর তাঁর জীবনের শেষ শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম এবং বর্ষা এখানেই অতিবাহিত করেন, এই সময় ঠাকুর খুবই অসুস্থ ছিলেন। গলায় এমন কষ্ট ছিল যে, উদ্যানবাটিতে থাকাকালীন তিনি কোনও দিন ভাত খেতে পারেননি। সুরমা এবং তরল জাতীয় খাবার মা সারদা দেবী তাঁর জন্য প্রস্তুত করতেন। কথামৃতের লেখক শ্রীম, ঠাকুরের মহেন্দ্রমাস্টার মাহেন্দ্র গুপ্ত আসতেন ঠাকুরের কাছে এবং তাঁদের কথোপকথনের ফল হল শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।
এই সময় ঠাকুরের ভক্তদের মধ্যে দুটি দলের সৃষ্টি হয়, যাঁরা ঠাকুরের সঙ্গে থাকতেন ও তাঁর দেখাশুনা করতেন, ত্যাগী ভক্ত। এঁদের মধ্যে ছিলেন শরৎ,শশী, বাবুরাম, রাখাল, নিরঞ্জন, বুড়ো গোপাল, লাটু, নরেন্দ্র প্রমুখ। এঁদের এখানেই সেবামন্ত্রের দীক্ষা দিয়েছিলেন ঠাকুর এবং এইস্থানেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বীজ বপন করা হয়, যা আজ মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। গৃহীভক্তদের মধ্যে ছিলেন মনমোহন, রাম দত্ত, সুরেন মিত্র, গিরিশ ঘোষ প্রমুখ।
ঠাকুরের জীবনের অন্তীম লীলা অর্থাৎ তাঁর কল্পতরু হওয়ার ঘটনাটি ঘটে এই বাড়িতে। ১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি, দুপুর ৩টেয় ইংরাজি নববর্ষের দিন। জীর্নদেহী যে মানুষটি একপাশ ফেরার সামর্থ পর্যন্ত ছিল না, তিনি একাই হেঁটে নেমে আসেন জলঘরের পেছনের দরজা দিয়ে দক্ষিনমুখী ফটকের দিকে অগ্রসর হয়। তাঁর পরনে ছিল লালপেড়ে ধুতি, লালপাড় বসানো চাদর, কানঢাকা টুপি, সাথে একটি পীরান এবং পায়ে জুতো। ঠাকুরের জন্যে অপেক্ষারত গৃহীভক্তদের সাথে দেখা করতেই এসেছিলেন, সকলের হাতে ছিল ফুল ও নানান উপহার সামগ্রী। পশ্চিমের আমগাছের ছয়ায় ঠাকুর গিরীশ, রাম, অতুল-সহ বেশ কয়েকজন ভক্তকে দেখতে পেলেন।
গিরীশকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘গিরীশ তুমি যে সকলকে এত কথা বলিয়া বেড়াও তুমি কি দেখিয়াছ ও বুঝিয়াছ?’
অর্থাৎ ঠাকুর তাঁর অবতারত্ব সম্পর্কে গিরীশের কাছে জানতে চাইলেন। গিরীশ তার উত্তরে বলেছিলেন, ব্যাস, বাল্মীকি যা ব্যাখ্যা করতে পারেনি তাঁর সম্বন্ধে! তিনি নিজে আর কি করে বলবেন? এই শুনে ঠাকুর ঐ আমগাছের তলায় দাঁড়িয়েই সমাধিস্থ হলেন। সেই দৃশ্য দেখে গিরীশ রামকৃষ্ণ নামের জয়ধ্বনি দিতে দিতে তাঁকে বারবার প্রণাম করতে লাগলেন।
ইতিমধ্যে ঠাকুর ভক্তদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমাদের আর কি বলবো, আশীর্বাদ করি তোমাদের সকলের চৈতন্য হউক’। এই অভয়বানী শুনে ঠাকুরের অন্যান্য ভক্তরাও ঠাকুরকে প্রণাম ও তাঁর উপর পুষ্পবর্ষণ করতে শুরু করলেন। ঠাকুর সকলের বক্ষ স্পর্শ করে তাঁর হাত নীচ থেকে উপরের দিকে সঞ্চালন করতে করতে বললেন তোমাদের চৈতন্য হোক। এই শুনে সকলেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। এক অদ্ভুত অনুভূতি তারা উপলব্ধি করে। তাদের কথা অনুযায়ী, চোখ বন্ধ করলেই তারা একটি জ্যোতি দর্শন করতে পারে এবং একটা শক্তি যেন তাঁদের দেহে ক্রমশঃ উপরে উঠে আসছিল। এর কিছুক্ষণ পর ঠাকুরের ভাবান্তর শেষ হয় এবং তিনি নিজ কক্ষে ফিরে যান। এই ঘটনার তেমন কোনও টের পাননি তাঁর ত্যাগী ভক্তরা, বা অনেকের মতে টের পেলেও তার অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বাড়িতে থাকা তাঁর অন্যান্য ভক্তেরা ঐ সময়ে এই ঘটনার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ঠাকুর ওই দিন মনবাঞ্ছারকৃপা কল্পতরু হয়েছিলেন, পরের দিন এই ঘটনার বিবরণ খবরের কাগজে প্রকাশিত হয় কিন্তু প্রথম দিকে তাঁর ত্যাগী ভক্তেরা এই ঘটনা মানতে নিমরাজি ছিলেন।
অনেক ভক্তেরই মতে ঐদিন ঠাকুর মনোবাঞ্ছারকৃপা কল্পতরু হয়েছিলেন। তারা এই ঘটনাকে ঠাকুরের কল্পতরু হওয়ার ঘটনা বলেই নির্দেশ করেন।
যদিও এই লীলা প্রসঙ্গে স্বামী সারদানন্দ এই ঘটনাকে ঠাকুরের অভয় প্রকাশ অথবা আত্মপ্রকাশ পূর্বক সকলকে অভয়দান বলে অভিহিত করেছেন। তারপর থেকে আজ অবধি প্রত্যেক ইংরেজী নববর্ষের প্রথম দিন কাশীপুর উদ্যান বাটিতে মহাসমারোহে পালিত হয়ে আসছে কল্পতরু উৎসব। আজও প্রতিবছর ১লা জানুয়ারী সর্বত্র কল্পতরু উৎসব পালিত হয়। শত শত ভক্ত আসেন এখানে। শতাব্দী প্রাচীন এই ঘটনা এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। অধ্যাত্মবাদ, ভক্তি, গুরু কৃপা আর বিশ্বাসের এক অদ্ভুত মিশেলে, কল্পতরু উৎসব নিজেই অনন্য এক নজির।