দেশ বিভাগে ফিরে যান

ইতিহাস থেকে মুঘল যুগ বাদ, ১৫২৬-১৮৫৭ খ্রি: পর্যন্ত কি ভারত গভীর নিদ্রায় ছিল?

April 10, 2023 | 4 min read

১৫২৬-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত কি গভীর নিদ্রায় চলে গিয়েছিল? ছবি: নিজস্ব

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাক্রম থেকে মুঘল ইতিহাস মুছে দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের কেন্দ্রীয় সিলেবাসে আর থাকবে না মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাহলে কী ঘটেছিল ভারতে? দিল্লিতে? আগ্রায়? রাজস্থানে? বাংলায়? বিহারে? লখনউয়ে? এই চরিত্রগুলি কি আদৌ ছিল কেউ? নাকি এই ৩৩১ বছর ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে ভারত চলে গিয়েছিল এক গভীর নিদ্রায়? তবে কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বলেও কিছু ছিল না? ভারতের ইতিহাসহীন, গৌরবহীন, সাফল্যহীন, ব্যর্থতাহীন, নিষ্ঠুরতাহীন, ধর্মহীন এই শূন্যকালের নিদ্রা তাহলে কবে ভাঙল? ২০১৪ সালে? এরকমই অনেক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের ‘ইতিহাস পরিবর্তনের’ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে।

স্কুলের পাঠ্যবই থেকে মুঘল ইতিহাসের অধ্যায় বাদ দেওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন মহলে নানান প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। যোগীরাজ্য অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকার বলেই দিয়েছে, সেখানকার সরকারি স্কুলগুলিতে এনসিইআরটি’র দ্বাদশ শ্রেণির সেই পাঠ্যপুস্তুকগুলিই গ্রহণ করা হবে, যেগুলিতে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টা নতুন নয়। এর সূচনা গত বছর। পাঠকক্রম যৌক্তিককরণ বা সিলেবাস ব়্যাশনালাইজেশন অনুশীলনের অঙ্গ হিসেবে এনসিইআরটি বলেছিল, ক্লাস ১২-এর পাঠ্যপুস্তক থেকে কিছু অংশ বাদ দিতে হবে, যা প্রায় একই ধরনের বিষয় এবং অপ্রসাঙ্গিক।

ভারতের ইতিহাসে মুঘল যুগ নিঃসন্দেহে একটা বড় পর্ব। মুঘল ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে কখনই ভারতের প্রাচীন ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু এরই মাঝে আরও একটি কথা উঠে আসছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের যে ইতিহাস বাদ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তার পরিবর্তে সেই স্থান পাঠ্যবইতে কোন বিষয় নেবে। আর যদি মুঘল ইতিহাসকে মুছে ফেলতে হয়, সেই সময় মুঘলদের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য ইতিহাস কি চিরতরে মুছে ফেলা হবে, ভুলিয়ে দেওয়া হবে? ভারতে যে সময় মুঘল সাম্রাজ্য কায়েম ছিল, সেই সময় দেশে সংস্কৃত ভাষায় বহু কাব্য ও সাহিত্য রচনা হয়েছিল।

যেমন সেই সময় সংস্কৃত জানা নামজাদা ও বিখ্যাত কবিদের মধ্যে অন্যতম নাম ছিলেন কবি জগন্নাথ পণ্ডিতরাজা। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, তিনি শ্রেফ নাম বদল করে একই কবিতা তিন রাজাকে শুনিয়েছিলেন। শাহজাহান, জগৎসিংহ এবং প্রাণনারায়ণ। কবি জগন্নাথকে পণ্ডিতরাজা উপাধী দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। পণ্ডিতরাজার অর্থ হলো পণ্ডিতদের রাজা। ইতিহাস বলে, কবি জগন্নাথ সুরাপান ও ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়াতে মজে থাকতেন। তাঁর লেখায় – “আমি যা চাই, আমাকে কেবলমাত্র দু’জন দিতে পারেন – ঈশ্বর, নাহলে দিল্লির সম্রাট। বাকি রাজারা আমায় যা দেন, তা আমি সপ্তাহে মুদির মাল কিনতে খরচ করি”

সেই সময়কার জনশ্রুতি ও ইতিহাসে অনুসারে, পণ্ডিতরাজা জগন্নাথ এক মহিলার প্রেমে হাবুডুবু খেতেন। তাঁর নাম ছিল লাভাঙ্গি । তাঁকেও বিয়েও করেছিলেন সংস্কৃত কবি। এই মুসলিম মহিলাকেই বহু শ্লোকে যবনী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সেখান কবি বলেছেন, তাঁর ত্বক মাখনের মতো মসৃণ। তিনি যখন তাঁর সঙ্গে সময় কাটান, তখন তাঁর না চাই ঘোড়া, না চাই হাতি, আর না চাই অর্থ।

ঔরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান সংস্কৃত শিখে ছিলেন। তাঁর লেখা ছ’টি কবিতা রসকল্পদ্রুমে সংরক্ষণ করা আছে। শাহজাহানের বড় ছেলে দারা শিকোহ, তিনিও সংস্কৃত আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল, ইসলাম এবং বেদান্তকে একে অপরের মাধ্যমে বোঝা।

সেই সময় আরও একজন কবি ছিলেন। কবীন্দ্রাচার্য, শাহজাহানের আমলে বারাণসী পণ্ডিত সম্প্রদায়ের প্রধান ছিলেন। অসাধারণ বাকপটু ছিলেন তিনি। সম্রাটের সামনে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কর বাতিল করার বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে প্রকৃতপক্ষে করটি বাতিল হয়। সারা দেশে কবীন্দ্রাচার্যের প্রশংসায় বহু কবিতা লেখা হয়েছিল, তার সবকটিই আজ কবীন্দ্র চন্দ্রোদয় বই আকারে সংরক্ষিত আছে।

দক্ষিণ ভারত এমন একটি জায়গা, যা বহু সংস্কৃত কবি উপহার দিয়েছে ভারতের ইতিহাসকে। সেই সময় দক্ষিণ ভারতের বহু সংস্কৃত কবি বিভিন্ন ধর্মের একাধিক রাজা-সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় দিয়ে কাটিয়েছিলেন। কবি ভানুকার ষোড়ষ শতকের সেরকমই একজন সংস্কৃত কবি। তিনি শ্লোক লিখেছিলেন, যা আমরা সুপরিচিত শ্লোক সঙ্কলনে দেখতে পাই। ভানুকরের শ্লোক সঙ্কলনে বিভিন্ন রাজা-মহারাজা-সম্রাটের প্রশংসা করা হয়েছে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে ছিলেন রাজা কৃষ্ণদেব রায়, নিজাম শাহ এবং শের শাহ, এঁরা সকলেই দাক্ষিণাত্যে শাসন করতেন। স্বাভাবিকভাবেই ভানুকরের সঙ্গে নিজামের ভালো সম্পর্ক ছিল। তাঁর উদারতা, সামরিক বিজয়ে দক্ষতা এবং এমনকি তার শারীরিক গড়ন নিয়ে শ্লোক ও পদ্যে প্রশংসা করা হয়েছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে আরও এরকজ সুপরিচিত সংস্কৃত কবি ছিলেন গোবিন্দ ভট্ট। তিনি রেওয়ারের রাজা বাঘেলা রামচন্দ্রের প্রশংসায় রামচন্দ্র-যশহ-প্রশস্তি রচনা করেছিলেন। কিন্তু রামচন্দ্র গোবিন্দ ভট্টের একমাত্র পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। বলতে গেলে, গোবিন্দ ভট্ট নিজেকে আকবরীয় কালিদাস নামে অভিহিত করতেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন মোঘল সম্রাট আকবর। একটি প্রশংসামূলক পদ্যে, তিনি আকবরকে হুমায়ুনের বংশের শ্রেষ্ঠ রত্ন হিসেবে প্রশংসা করেছেন।

তবে মুঘল যুগে লেখা সব সংস্ক শ্লোক বা পদ্য কিন্ত সম্রাটদের সম্পর্কে নয়। সপ্তদশ শতকের কবি নীলকণ্ঠ শুক্ল সেরকমই এক উদাহরণ। তিনি বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ ভট্টোজি দীক্ষিতের শিষ্য ছিলেন। কবি নীলকণ্ঠ মুঘল আমলে বেনারসের একজন ব্রাহ্মণ গৃহশিক্ষক এবং একজন মুসলিম সম্ভ্রান্ত মহিলার মধ্যে প্রণয় নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করেছিলেন।

ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ যেখানে সংস্কৃত কবিরা ইসলামী শাসনে শ্লোক, কাব্য, সাহিত্য রচনা করেছিলেন, তেমনই আবার রামায়ণ, মহাভারত, এমনকি শুকসপ্ততির মতো ধ্রুপদী সংস্কৃত কাব্য, সাহিত্য ফার্সি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। রজমনামা, এটি মহাভারতের একটি ফার্সি অনুবাদ। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে আকবর কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল এই রজমনামা। বলা হয়, ইসলামের একেশ্বরবাদী দেবতা এবং সংস্কৃত মহাকাব্যে বর্ণিত অগণিত দেবতাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতেই রচিত হয়েছিল এই ফার্সি অনুবাদ। তার সঙ্গে স্থান পেয়েছে কোরানে লেখা বহু কথা-বাগবৈশিষ্ট। উল্লেখিত আছে, আল্লাহর কাছে আদাহ উদ্দেশে বর্ণিত নামাজ।

এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কিভাবে জানবেন, এতসব কথা। কোনও বই, কোনও পাণ্ডুলিপি, কিংবা শিলালিপি থেকেও এসব উদ্ধারের চেষ্টাও করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, সেই দায়িত্ব কার? পাঠ্যবই থেকে ভারতীয় ইতিহাসের একটি যুগ বাদ দেওয়া হচ্ছে, তাহলে মুঘল আমলের সংস্কৃত সাহিত্যও কি মুছে ফেলা হবে? মুছে ফেলা হবে কি সংস্কৃত সাহ্যিত্য মুঘল সম্র্রাট, নিজামদের প্রশংসার কথা?

আবার মুঘলদের পাশাপাশি নাথুরাম গডসের গান্ধীহত্যা কিংবা আরএসএসকে যে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলই নিষিদ্ধ করেছিলেন, সেই অধ্যায়গুলিও বাদ দেওয়া হয়েছে নয়া সিলেবাসে। অথচ নাথুরাম গডসে নিজে ছিলেন চরম আরএসএস বিরোধী। একটা সময় সঙ্ঘের সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু তারপর একদিন হঠাৎ রেগে সদস্যপদ ছেড়েও দেন। এমনকী আরএসএসকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, ওরা হিন্দুদের নপুংসক হিসেবে তৈরি করছে। কেন? কারণ, সংস্কৃতি ও চরিত্র গঠনে আরএসএস যে ভূমিকা ও ব্রত নিয়েছিল, নাথুরাম মনে করতেন তা আদতে দুর্বলতা। ১৯৩৯ সাল থেকে অগ্রণী পত্রিকায় নাথুরাম লাগাতার লিখে এসেছেন যে, আরএসএস হিন্দুদের মধ্যে থেকে আগ্রাসী, যোদ্ধা মনোভাবকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
সেই নাথুরাম যখন মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে, তখন আরএসএসের অন্যতম প্রধানত চিন্তাবিদ এম এস গোলওয়ালকর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এরকম জঘন্য মনোবৃত্তির এক ব্যক্তি যে আমাদের দেশেরই নাগরিক, এটা আমাদের কাছে আরও বড় এক যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে। মহাত্মা গান্ধীর মতো এক মহাপ্রাণ মানবিকতার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদিত করেছিলেন। তাঁকে হত্যা করা শুধু তাঁর প্রতি নয়, গোটা দেশের প্রতি এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা।’

এই সব দেখে অনেকেই আবার বলছেন, এবার নিশ্চই ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ ব্রিটিশ পিরিয়ড ভারতের ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কারণ তা যে আমাদের পরাধীনতার দগদগে গ্লানি বহন করে!

বিজেপির আদর্শ গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) শিক্ষায়। যাঁদের নীতি ও আদর্শের আর প্রধান চালিকাশক্তি একটি বিশেষ গ্রন্থ। ‘হিন্দুত্ব’। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত। লেখক দামোদর বিনায়ক সাভারকর। ঠিক দু’বছর পর কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার গঠন করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ‘হিন্দুত্ব’ নামক গ্রন্থের সারকথা কী? হিন্দুত্ব কোনও ধর্ম নয়। এটি একটি জাতি। ভারতে বসবাসকারী প্রত্যেকের রক্তে হিন্দুত্বের জিন। আরএসএসের তাই প্রধান লক্ষ্য হল হিন্দুরাষ্ট্র গঠন। এই লক্ষ্য নিয়ে কোনও আপস নেই আরএসএসের। আর তাই মুঘল অথবা ব্রিটিশ, যে কোনও বিদেশি সংস্কৃতিই হল হিন্দুত্বের পরিপন্থী। আর সেই লক্ষ্যেই তারা এগোচ্ছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Mughal Empire, #Mughal, #Indian History, #text books, #Mughal history

আরো দেখুন