বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

গ্রাম বাংলায় এখনও পূজিত হন লৌকিক দেবতা কালুরায়

May 19, 2023 | 2 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলার লোক সংস্কৃতিতে কালুরায় একজন অনার্যদের দেবতা। কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাবার বিশ্বাসে কালু রায়ের পুজো দেওয়া হয়। সাধারণত সুন্দরবনের জল ও বনজীবী মানুষরা তাঁর পুজো করেন। অপরদিকে রাঢ়বঙ্গে ধর্মরাজ কালু রায়ের পুজো করা হয়। এই ধর্ম পুজোয় ব্রাহ্মণ লাগে না। এখন লোকে বলে কালা রায়। তৎকালে ডোমেরা এই পুজোর দায়িত্ব সামলাতো। বর্তমানে জেলে পন্ডিত এই পুজোর পূজারী।

তবে শোনা যায়, সুন্দরবনের কালুরায় ও রাঢ়ের ধর্মঠাকুর এক নয়। কোনও কোনও উপাখ্যানে জানা যায় যে, কালুরায় মহিষের দেবতা। মেদিনীপুরের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই দেবতার বাস। কিংবদন্তি অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের উত্তর রায় এবং দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণরায় বড়ভাই কালু রায়ের কাছে মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে হেরে গিয়ে উত্তরে এবং দক্ষিণে পালিয়ে যান। উত্তর রায় সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না, তবে দক্ষিণরায় বাঘের দেবতা। মানুষের বশ্যতা মেনে মহিষ বাঘকে হারিয়ে দেয়, সেই রকমই কালুরায় হারিয়ে দেন দক্ষিণরায়কে।

গ্রামের মানুষ দক্ষিণরায়ের যেমন আকৃতি দিয়েছে কালু রায়ের তেমন কোনও আকৃতি দেয়নি। কোথাও একটি, কোথাও তিনটি, কোথাও আবার পাঁচটি গোলাকার প্রস্তরখন্ড এই দেবতার প্রতীকরূপে দেখা যায়। তবে বাংলার কোথাও কোথাও কালুরায়ের মানবীয় মূর্তির খোঁজ মিলছে। পোশাক পৌরাণিক যুদ্ধ-দেবতার মতো। দুই হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো, পিঠে তীর ধনুক।

কালুরায়ের মন্দির সেভাবে দেখা যায় না, গাছের তলাতেই তার পূজা হয়। মন্দির খুব কম সংখ্যকেই আছে। কালুরায়ের নামে অনেক দেবদত্ত জমি আছে। সেই জমির লিজের টাকায় এই দেবতার বাৎসরিক উৎসব হয়। সাধারনত এই দেবতা নিম্নবর্গীয় মানুষের দ্বারাই পূজিত হন। কালুরায়ের ডানদিকে থাকে দক্ষিণরায় ও চন্ডী আর বাম দিকে উত্তর রায় ও মঙ্গলাদেবী। কালুরায় অধ্যুষিত এলাকায় যে এক সময় প্রচুর মহিষের আধিক্য, তাই কিছু অঞ্চলের নাম মহিষাদল, মহিষগোট প্রভৃতি।

‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে দক্ষিণ রায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। দক্ষিণ বঙ্গের ‘কাণ্ডহীন মুণ্ডমূর্তি’ ‘রায়ঠাকুরই’ যে দক্ষিণ রায়, সে কথা বলে কবি তাঁর দেহহীনতার কারণ বর্ণনা করেছেন –

“বাঘের উপরে নাহি দক্ষিণের রায়।
একখানি মুণ্ড মাত্র বারা বলে তায়।।
এমন প্রকার পূজা কেন হয় হেথা।
জান যদি কহ শুনি দুই এক কথা।। …
শূন্যা বড়খাঁ গাজী পড়তেক পীর।
ঠাকুর দক্ষিণ রায় আঠার ভাঁটির।।
দুইজনে দোস্তানী হইয়াছিল আগে।
তারপর হুড়োহুড়ি মহাযুদ্ধ লাগে।।
দক্ষিণ রায়ের বুকে মারে বড় গাজী।
পড়িয়া উঠিয়া রায় বলে মায়া বাজী।।
বড়খাঁ হানিল খাঁড়া গলায় তাহার।
মায়ামুণ্ড ক্ষিতি পড়ে এমনি প্রকার।।
বিরোধ ভাঙ্গিয়া দিল আসিয়া ঈশ্বর।
তারপরে দোস্তানী পাইল দোঁহে বর।।
কাটামুণ্ড বারা পূজা সেই হতে করে।
কোনোখানে দিব্যমূর্তি ব্যাঘ্রের উপরে।।”

পূজামন্ত্ররূপে মহাকাল ভৈরবের মন্ত্র উচ্চারিত হয়। নৈবেদ্য রূপে ফলমূল, কলা, আতপচাল দেওয়া হয়। কালু রায়কে কেন্দ্র করে একটা ছড়া প্রচলিত আছে-

“উত্তর দক্ষিণরায়ে রাখি দুই পাশে

মধ্যস্থলে জ্যেষ্ঠ কালুরায় বসে।

সবার দক্ষিণে চন্ডী বামেতে মঙ্গলা,

পঞ্চরূপে পৃথিবীতে করেন লীলাখেলা।

কোথা একা, কোথা তিন, কোথা পঞ্চজন

নির্ভয়েতে কালুরায় করেন বিচরণ

ঘরবাড়ি নাহি কিছু বাস বৃক্ষতলে,

সদাচিন্তা কি যে হবে গ্রামের মঙ্গল।

বন্দো কালু রায়ে সবে গ্রামের দেবতা

গ্রামের ভরসা বিপদেতে রক্ষাকর্তা।’

জানা গেছে, আবার জলা জঙ্গলের দেবতা কালুরায়, আর রাঢ় অঞ্চলের কালুরায় আলাদা। যেমন সুহারি গ্রামের ধর্মঠাকুর কালাচাঁদ বা কালুরায় নামে পরিচিত। মূর্তি কুমিরের। বাহন-সাদা ঘোড়া। পূজার পর দুটি পালকিতে সারা গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামে ঘোরানো হত তাঁকে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ও মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণতম অংশের পল্লী ও বনাঞ্চলে তিনি ‘দক্ষিণরায়’, ‘বাঁকুড়ারায়’, ‘বনবিবি’, ‘বড়খাঁ গাজী’ প্রভৃতির মতন বাঘেদের দেবতা, আবার কোন কোন জায়গায় বাঘ ও কুমির – উভয়ের দেবতা বলে খ্যাত।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#West Bengal, #Kalu Ray

আরো দেখুন