রাঢ় বাংলার ‘সিনি’ পুজো, আজও নানা ধর্মের মিলনক্ষেত্র
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলার সংস্কৃতিতে লৌকিক দেবদেবীর ইতিহাস সুপ্রাচীন ও সমৃদ্ধ। রাঢ় বাংলার এমনই এক জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা ‘সিনি’। মাঘ মাসের প্রথম দিন বা বিশেষ ক্ষেত্রে মকর সংক্রান্তিতে সিনি দেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়। লোকসংস্কৃতি গবেষক মানিকলাল সিংহের মতে, আদিবাসী শব্দ ‘সুনিয়া’ থেকে ‘সিনি’ শব্দটি এসেছে। সুনিয়া শব্দের অর্থ ‘আদি’। ‘আদি’ অর্থে জননী বোঝাতে পারে। (ষষ্ঠী ও সিনি – সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ৬০ বর্ষ)।
আজও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও হুগলী জেলার প্রান্তিক গ্রামগুলিতে জনমানবহীন গাছের তলায় সিনি দেবীর পুজোর প্রচলন রয়েছে। হাতি-ঘোড়ার প্রতীক, কিছু কিছু স্থানে সিঁদুরলিপ্ত পাথরের টুকরো দেবীর প্রতীক রূপে তিনি বিরাজিত।
সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর হিন্দুজাতি, আদিবাসী- উপজাতি, বাগদী, মহাদণ্ড, বাউরী, লোহার, ভূমিজ, দুলে, মাঝি, সাঁওতাল জাতি এই দেবীর উপাসক। ব্রাহ্মণ পুরোহিত সিনি দেবীর পুজো পৌরহিত্য করেন। ভক্তদের বিশ্বাস, সিনি দেবী গ্রামরক্ষাকারী, জল, বৃষ্টি ও শষ্যের দেবী। একে তুষ্ট করলে সমাজে সব বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, এমনকি দুর্ভিক্ষ, মহামারী, হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কথিত আছে, অতীতে এই দেবী ডাকাতদের আরাধ্য ছিল। সিনি পুজো-উৎসবের দিন কোথাও আগুনের ওপর দিয়ে ভক্তরা হেঁটে যায়। কোথাও সংকীর্তন হয়, আবার কোথাও বলিদানের প্রথা রয়েছে। বাঁকুড়ার সিনি পুজোতে লৌকিক ধর্মের সঙ্গে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মাচারণ যেন মিশে গিয়েছে।
এই পুজোর বিশেষ মন্ত্র নেই। সিনি দেবীর নির্দিষ্ট কোনও মূর্তি নেই। দেবীকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে পুজো করেন না। তিনি কারও গৃহে থাকেন না। সিনি দেবী হলেন গ্রাম দেবতা। গ্রামগতভাবেই দেবীর পূজার্চনা করা হয়। দুপুর বেলা পুজো আরম্ভ হয়। পুজাকালে পুরোনো থান ভেঙে ফেলে, গ্রামবাসীরা নতুন বেদী তৈরি করেন। টেরাকোটার হাতি, ঘোড়াগুলোকে ঐস্থানে ঐ দেবীতে স্থাপন করা হয়। পাথর খন্ডের উপর সিঁদুর দিয়ে দেবীর প্রতীকী চোখ আঁকা হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে পুরোহিত কিছুক্ষণ ধ্যান করেন। হাতি-ঘোড়াগুলির উপরেও সিঁদুর লেপে দেওয়া হয়। পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে দুধ, দই, বাতাসা, চাল, কলা নিবেদন করা হয়। এই পুজোয় নিরামিষ আমিষ উভয় প্রকার অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়।
লৌকিক ইতিহাসে নানান ধরনের সিনি দেবীর কথা জনা যায়। বাঁকুড়া জেলার লোকসংস্কৃতি গবেষক মিহির চৌধুরী প্রায় ৯৬টি সিনি দেবতার কথা উল্লেখ করেছেন।
অসংখ্য দেবদেবীর থানে সিনি দেবীর নানা রূপে দেখতে পাওয়া যায়
ঘাঘরা সিনি:
মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি অঞ্চলে তারাফেনী নদী তীরবর্তী ঘাঘরা গ্রামে সিনি পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। এই সিনি পুজো গ্রামের নামে ঘাঘরাসিনি পুজো নামেই পরিচিত। সিনিদেবীদের মধ্যে ঘাঘরাসিনি দেবীই সবচেয়ে বিখ্যাত। একটি প্রস্তর মুন্ড হল দেবীর প্রতীক। সিঁদুর, কাজল আর মেথি দিয়ে পাথরের মধ্যে দেবীর চোখ আঁকা হয়। পুজোর অর্ঘ্য হিসেবে ফল, চিঁড়ে, গুড় নিবেদন করা হয়। মাতৃবেদীর উপর আরশি, চিরুনি, শাড়ি, সিঁদুরের ঠোঙা, টাঙ্গি, লাঠি দেওয়া হয়। গ্রামপতি ও তার স্ত্রী এই পুজোয় পৌরহিত্য করেন। এখানে পশু বলিরও চল রয়েছে। কোনও সন্তানের জন্ম নিয়ে বা বাবা মায়ের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ- সংশয় থাকলে দেবী নিজেই এ দিন তা দূর করেন বলেই, প্রচলিত বিশ্বাসে মনে করা হয়।
দীঘল সিনি:
বাঁকুড়ার মাজমুড়া গ্রামে দীঘল সিনির পুজো হয়। গ্রামের উত্তর দিকের একটি মাঠে অবস্থান করা একটি কৃষ্ণ বর্ণের পাথরকে দীঘল সিনি রূপে পুজো করা হয়। কৃষিক্ষেত্র থেকে সমস্ত ফসল তোলা হয়ে গেলে, শস্য রক্ষাকারিনী রূপে মায়ের পুজো করা হয়। বছরে মাত্র একদিনই দেবীর আরাধনা করা হয়।
সোনা সিনি:
বাঁকুড়ার সোনাতপলে গ্রামের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সোনা সিনি নামে নাম হয়েছে। পলাশ গাছের তলায় নির্দিষ্ট থানে এই পুজো হয়। কথিত রয়েছে, প্রস্তর খন্ডের মধ্যে সোনা সিনির মুখ দেখতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, সোনা সিনি বুদ্ধের মুখের আদলে ঘটিত।
বামনি সিনি:
বাঁকুড়া জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত সিনি হলেন রানীবাঁধের রাজাকাটা অঞ্চলের ভূড়কুড়া গ্রামের বামনি সিনি। বামনি সিনি হলেন অরণ্য দেবী। অরণ্যের হিংস্র পশুর হাত থেকে রক্ষা পেতে এই পুজো। পয়লা মাঘে পাহাড়ের ওপরে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। পুজোতে পায়রা, হাঁস, পাঁঠা ইত্যাদি বলি হয়। এই পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে, সেখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।
লদা সিনি:
ওন্দা থানার লোদনা গ্রামে লদাসিনির পুজো করা হয়। গ্রাম দেবতা সিনি এখানে দুর্গার প্রতিকী রূপ হিসেবে পুজো পান।
সোনাই সিনি:
বাঁকুড়া থানার জুনবেদিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন সোনাদহ গ্রামে সোনাই সিনি মাঠে আছে সোনাই সিনি ঠাকুরের থান। লোক বিশ্বাসে সোনাই সিনি এখানে মা দুর্গার এক রূপ। এখানে মাঘী পূর্ণিমার দিন সোনাই সিনি মায়ের পুজো। মাঠের মধ্যে গাছতলায় সোনাই সিনি মায়ের থান। পাশে আছে একটি হরি মন্দির। সেখানে এই উপলক্ষ্যে শুরু হয় তিনদিনের সংকীর্তন। সোনাদহ, লক্ষ্মীজনার্দনপুর ও বড় কালঝরিয়া, এই তিনটি গ্রাম মিলে আয়োজন করে এই অনুষ্ঠান।
ছেকো সিনি:
বাঁকুড়া থানার পুরন্দরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বনকাটা গ্রামের গ্রাম্যদেবী ছেকো সিনি। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের তিন তারিখে হয় ছেকো সিনির পুজাপাঠ ও নাম সংকীর্তন। এদিন বনকাটা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রত্যেকের বাড়িতে রান্না বন্ধ থাকে। কারণ পুজোর খিচুড়ি প্রসাদ সবাই গ্রহণ করে। গ্রামের মঙ্গল কামনায় পূজার আয়োজন। কোনও প্রতিমা নেই। পোড়া মাটির হাতি ঘোড়াতেই পুজো হয়। এই উপলক্ষ্যে দুদিন মেলা বসে। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে।
বেড় সিনি:
তালডাংড়া থানার হাড়মাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের খিচ্কা গ্রামে আছে বেড়া সিনি বা বেড় সিনি ঠাকুর। মকর সংক্রান্তিতে এই দেবীর পুজো হয়। চারদিন ধরে চলে মেলা। পুজোয় হয় খিচুড়ি প্রসাদ। ৪বদিন ধরে চলে সংকীর্তন।
জঙ্গল সিনি:
বেলিয়া তোড় থানার ছান্দার গ্রামে রাস্তার ধারে জঙ্গলে সিনি মায়ের থান। এখানে দোলের দিন পূজা হয়। এই উপলক্ষ্যে হয় সংকীর্তন। প্রতিমা বিহীন পূজা। জঙ্গল সিনি মায়ের প্রতীক হিসাবে আছে পোড়া মাটির হাতি ঘোড়া।
চন্দ্র সিনি:
রাইপুরের গ্রামে কংসাবতী নদীর তীরে একটি গাছতলাতে পয়লা মাঘ চন্দ্র সিনির আরাধনা করা হয়। এখানেও সিনি দেবীর কোনও মূর্তি নেই। পোড়া মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া প্রতীকেই পুজো হয়।
সিমন সিনি:
সিমলাপালের পার্শ্বলা গ্রামে সিমন সিনি বা সিমল সিনি পুজো হয়। সিনি দেবী এখানেও অবয়বহীন, গাছতলাতেই দেবীর থান। খয়রা সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পুজোর আয়োজক। পয়লা মাঘ সিমন সিনি পুজো হয়। পুজোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটা। যারা মানসিক করেন, স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে তারা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। এই দেবী গ্রামের দেবী। এই পুজো নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। একদা এই গ্রামের কোন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক নি:সন্তান ব্যক্তি গ্রাম্য পুরোহিতের পরামর্শে এই পুজো করেন। তারপর তার এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সেই থেকেই পুজোর শুরু।
ঝমকা সিনি:
৫ই মাঘ ঝমকা সিনির বিশেষ পুজো হয় । সিমলাপালের দুবরাজপুরের ঝমকা গ্রামে এক গাছতলাতে প্রায় ৭৫ বছর ধরে এই পুজো চলে আসছে।। শিলাবতী নদীর তীরে সারা বছর মায়ের থানে পোড়া মাটির হাতি ঘোড়া দিয়ে পুজো হয়। ২দিন ধরে চলা এই অনুষ্ঠানে গ্রামীণ মেলাও বসে। দ্বিতীয় দিনের বিশেষ আকর্ষণ হল যাত্রা। কেবলমাত্র বার্ষিক পুজোর সময় প্রতিমা তৈরি করা হয়। দেবী এখানে দ্বিভূজা এবং ঘোড়ার পিঠে আসীন হন। অষ্টমঙ্গলায় অর্থাৎ ৮ দিন পরে সিনি প্রতিমার বিসর্জন হয়।
পাথরি সিনি:
সিমলাপাল থানার মণ্ডল গ্রাম পঞ্চায়েতের পাথ্রি গ্রামের গ্রাম্যদেবী ‘পাথ্রি সিনি’। জয়পন্ডা নদীর ধারে মায়ের থান। এখানে বার্ষিক পূজা হয় সরস্বতী পুজোর ২ দিন পর। সরস্বতী পূজা হয় মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে। আর পাথ্রি সিনির পূজা হয় সপ্তমী তিথিতে। পূজার দিন রাতে হয় নিশি পূজা। নিশি পূজাতে হয় পাঁঠা বলি। সন্ধ্যায় ছোটদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়। তারপর ২দিন ধরে হয় যাত্রা।
বৌদ্ধ, জৈন এবং হিন্দু সংস্কৃতির এক অনন্য মিলন ক্ষেত্র হল রাঢ় বাংলা। এখানেই আর্য ও অনার্যরীতির মেলবন্ধন হয়েছিল। ধৰ্মীয় সংস্কৃতির এই বিনিময়ের মাধ্যমে রাঢ় বঙ্গে সিনি দেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছে, যা কালে কালে সমাজের নানান স্তরে পৌঁছে গিয়েছে।