নজরুলের রাজনৈতিক বিশ্বাস: বিদ্রোহী কবি কি বামপন্থী ছিলেন?

শোষিত লাঞ্ছিত নিপীড়িত মানুষের জন্য সোচ্চার ছিল নজরুলের কলম। মানবতাবাদী নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ।

May 26, 2023 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: হালের ভারতে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির মধ্যে পড়েছেন বরেণ্য মানুষেরা। নজরুলও আজ ব্যতিক্রম নন। কিন্তু আদত নজরুল কেমন ছিলেন। তিনি কি বামপন্থী ছিলেন? সাম্যবাদ, বিদ্রোহ ঝরে পড়ত তাঁর লেখায়।

হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নয়, মানুষের পরিচয় সে বঞ্চিত, শোষিত নিপীড়িত কিনা। শোষিত লাঞ্ছিত নিপীড়িত মানুষের জন্য সোচ্চার ছিল নজরুলের কলম। মানবতাবাদী নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ। নজরুল মানবপ্রেমের সঙ্গে দেশপ্রেমকে মিশিয়েছেন, মাতৃভূমিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’

‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’

অবার দেখা যায়-

‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম-জাতি
সব দেশে-সবকালে, ঘরে ঘরে মানুষের জ্ঞাতি।’

‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার চিত্র উঠে এসেছে অবলীলায়-

‘মাভৈ! মাভৈ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ,
সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান-গোরস্তান!
ছিল যারা চির-মরণ-আহত,
উঠিয়াছে জাগি’ ব্যথা জাগ্রত,
‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অর্জুন’ ছোঁড়ে বাণ।
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।
মরে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ,
বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ মরণে নাহি লাজ।’

রুশ বিপ্লবের পটভূমিতে তিনি লিখে ফেলেন,
‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।’

এই কবিতাই সাম্যবাদী নজরুলের জন্ম দিয়েছিল। তাঁর ‘মুক্তি’ কবিতাটিই তাঁর সাম্যবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছে। এই মুক্তি কবিতাটির সুবাদে তাঁর সঙ্গে মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও পরিচয় হয়। কাকাবাবুর কারণেই নজরুল জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে, ১৯২১ নাগাদ এই ঘরে থাকতে আরম্ভ করেন দুজনে। এরপর ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘নবযুগ’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা হয়ে ওঠে সাম্যবাদী চিন্তার মুখপত্র। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট থেকে নজরুলের একক চেষ্টায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ধূমকেতু। ধূমকেতু রাজনৈতিক কাগজ হিসেবে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুজফ্ফর আহমেদ লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। কাজী নজরুল ইসলামকে লাঙল পত্রিকার দায়িত্ব দেন কাকাবাবু।

লাঙল-এর প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল ‘সাম্যের গান’ নামের কবিতাটি লেখেন-

গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
-গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
-বন্ধু, যা খুশী হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা খুশী পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, য্ত সখ
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি?পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!

গণবাণীতেই নজরুল ১৯২৭ সালে মে দিবসে শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিক সঙ্গীত বা ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গানের বঙ্গানুবাদ করেন। গানটি ফরাসী শ্রমিক কবি ইউজিন পাতিয়ের রচিত। এই গানটি আজও সারা বিশ্বের কমিউনিস্টরা দলীয় সঙ্গীত হিসেবে গেয়ে থাকেন। নজরুল অনুবাদটির নাম দিয়েছিলেন ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’। তিনি একের পর এক ‘শ্রমিকের গান’, ‘লাল পতাকার গান’, ‘ধীবরের গান’ ইত্যাদি শ্রমজীবী অংশের মানুষের শ্রেণী চেতনার গান লেখেন। মার্কসীয় চেতনার গভীর প্রভাব রয়েছে নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতায়। আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মেহনতী মানুষের কথা। নজরুল হয়ে ওঠেন মেহনতী মানুষের কণ্ঠস্বর, যে কারণে সহজেই মনে হয় তিনি বামপন্থী। আদপে তিনি ছিলেন মানুষের প্রতিনিধি।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen