‘জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ’ করেই অমর তুষার কাঞ্জিলাল
সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের রাঙাবেলিয়া হাইস্কুলে তখন প্রার্থনা চলছে। হঠাৎই একটি ছেলে অজ্ঞান হয়ে গেল। খবর পৌঁছল হেডমাস্টার মশাইয়ের কানে। তিনি তখন সদ্য স্কুলে যোগ দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ছেলেটি বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে আসেনি৷ রাঙাবেলিয়া-সহ পার্শ্ববর্তী তিনটি গ্রামে এরপর তিনি খোঁজখবর শুরু করলেন। জানা গেল, বহু ছাত্রছাত্রীই অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার জন্য না খেয়ে স্কুলে আসতে বাধ্য হয়৷ এই ভাবেই প্রধান শিক্ষক তুষার কাঞ্জিলাল ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লেন তাঁর স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সুন্দরবনের জীবনচর্যায়।
শুধু পুঁথিগত তত্ত্বকথায় ভরসা না করে সুন্দরবনের জল-জঙ্গলঘেরা প্রান্তিক মানুষের জন্য হাতেকলমে কাজ করতে নেমে পড়লেন তুষারবাবু। ১৯৬৭ সালে রাঙাবেলিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদানের আগেই যিনি বাংলার বামপন্থী রাজনীতির পরিচিত মুখ৷ সামনে ছিল নিশ্চিন্ত শহুরে জীবন কাটানোর সোনালি হাতছানি৷ সে সব ছেড়ে, সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বসত গড়লেন সভ্যতার আলো থেকে অনেক দূরের গ্রহসদৃশ সুন্দরবনে৷ এরপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে রাঙাবেলিয়ায় থেকে ভারতীয় সুন্দরবনের নানা প্রান্তে গ্রামোন্নয়নের কাজ করে চললেন ধারাবাহিক ভাবে৷
কাউকে সরাসরি অর্থ সাহায্য করার চেয়ে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করেছেন আজীবন৷ বারবার তাঁর মুখে শুনেছি ‘ভিখারি দিয়ে বিপ্লব হয় না৷’ সুন্দরবনের মানুষ তাঁদের জীবন জীবিকা থেকে যাতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেন, সে ব্যাপারেই তাঁর আগ্রহ দেখেছি নিরন্তর৷ পান্নালাল দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি সুন্দরবনের কৃষিনির্ভর মানুষকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টায় ব্রতী হন৷ বৃষ্টিনির্ভর এক ফসলি জমিতে চাষ করে সারা বছরের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব বলে ধারণা ছিল এক সময়ে৷
বৃষ্টির জলকে তিনি চাষের জমির মধ্যে ছোট ছোট পুকুর খুঁড়ে ধরে রেখে কৃষিকাজে লাগানোর কথা কৃষকদের বোঝাতে পেরেছিলেন৷ তাঁর সংগঠনের মূল ভিত্তি লুকিয়ে ছিল ‘পাড়া মিটিং’গুলিতে৷ গ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন, বোঝাতে পেরেছিলেন উন্নয়নের প্রকৃত অর্থ৷ এ ভাবেই রাঙাবেলিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোটা সুন্দরবনের ‘মাস্টারমশাই’ হয়ে উঠেছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতায়৷
সুন্দরবনের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নে তুষারবাবুর অবদান প্রশ্নাতীত৷ রাঙাবেলিয়া ছাড়িয়ে সংগঠনের শাখা সক্রিয়ভাবে ছড়িয়েছে সাগর, হিঙ্গলগঞ্জে৷ এই লড়াইয়ে যোগ্য সহযোদ্ধার মতো সাথে ছিলেন সহধর্মিনী বীণা কাঞ্জিলাল৷ তিনিও সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে রাঙাবেলিয়া স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন ষাটের দশকে৷ আজও যে কোনও দিন রাঙাবেলিয়া গেলে আমরা দেখতে পাই, সুন্দরবনের মেয়েরা হাতের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে রেখেছেন, আর সেই সমস্ত সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতির বিক্রয়কেন্দ্রগুলিতে৷ স্বাবলম্বী এই মেয়েদের মধ্যেই চির অমরত্ব তুষার-বীণার স্বপ্নের৷
পাশাপাশি, নদীবাঁধ রক্ষায় ম্যানগ্রোভের গুরুত্ব যে কতটা, সাধারণ মানুষকে তা বোঝাতে অক্লান্ত ছিলেন তুষারবাবু৷ দেশের বাইরেও সুন্দরবনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন নানা লেখায়, বক্তব্যে৷ গ্রামোন্নয়নের ভাবনায় তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজির অনুগামী৷ বারবার বলতেন ‘জীবনে জীবন যোগ করা’র কথা৷ শহরের নিশ্চিন্ত-প্রাপ্তির আনন্দ ছেড়ে পাঁচ দশকেরও আগে জলজঙ্গলের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সুন্দরবনে পা রাখা এবং জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় সেই দ্বীপভূমির প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে থেকে তাঁদের আলোর দিশা দেখানো যে আসলে ‘জীবনে জীবন যোগ করা’ই, তা দেখিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি৷ আজ তাই সুন্দরবন ও তুষার কাঞ্জিলাল বারংবার একই সঙ্গে উচ্চারিত। সমার্থকও।
(লেখক জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী – ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ পত্রিকার সম্পাদক)