রাজ্য বিভাগে ফিরে যান

আলোয় ফিরছে পাচার হওয়া অজস্র তরুণী

February 1, 2020 | 3 min read

মিলে যাচ্ছে। সব মিলে যাচ্ছে।

চোখের সামনে থেকে একের পর এক পর্দা সরে যাচ্ছে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দিল্লি, মুম্বই, পুনে-সহ নানা জায়গার সেই অন্ধকার জায়গাগুলো। যেখানে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল ওই সব শহরের বিভিন্ন যৌনপল্লিতে।

অথচ এক দল বক্তা, অন্য দল শ্রোতা। কিন্তু তাও তাদের মধ্যে অমিলের থেকে মিলই বেশি। এরা প্রত্যেকেই কখনও পাচার হয়ে গিয়েছিল। কেউ ফিরে এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যকে পথ দেখাচ্ছে আর কেউ সেই পথ চিনছে।

এ ভাবেই আলোয় ফেরা মেয়েরা পথ দেখাচ্ছে সেই সব মেয়েদের, যারা এখনও দিশাহীন। তারা অন্ধকার জীবন থেকে ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু পথের দিশা পায়নি। খড়কুটোও নেই আঁকড়ে ধরার নেই। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত তারা। তারা ধরেই নিয়েছে জীবনটা থেমে গেছে। এগনোর আর পথ নেই।

কিন্তু ওরাও হাল ছাড়ে না। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার লড়াই চলতে থাকে। নিজেদের উদাহরণ দিতে থাকে, ফতিমা, মানোয়ারা, নিরুপমা, রিয়া, দিয়া, শ্রী, জেসমিনরা (আইনি কারণে সব নাম পরিবর্তিত)। এই আলোয় ফেরা মেয়েদের নিজস্ব একটা দলও রয়েছে — বন্ধনমুক্তি। যা অতীতের বাঁধন ছিঁড়ে নতুন পথে ব্রতী হতে শেখায়। অন্ধকারের জীবন থেকে মুক্তি দেয়।

সেই দলেরই ফতিমা নিজের কথা বলছিল। বছর ১৭-র রোগাসোগা মেয়েটাকে দেখলে মনে হবে কেমন যেন ভিতু ভিতু হাবভাব। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকালে আগুন ঝরে। সেই আগুনেই ভরসা রেখেছিল পুলিশ। ফতিমার কথায়, ‘এক দিন পুলিশ বলল ওদের সঙ্গে যেতে হবে। পাচারকারীকে ধরতে হবে। আমার মনের মধ্যে যেন উথালপাথাল শুরু হল। হ্যাঁ, শয়তানটাকে ধরিয়ে দিতেই হবে। পুলিশ গিয়ে হানা দিল এক যৌনপল্লিতে। চিনিয়ে দিলাম আমিই। একে একে ৬টা মেয়ে উদ্ধার হল। ধরা পড়ল পাচারকারীও।’ এ কথা শুনে হাততালিতে ফেটে পড়ল সকলে। যে মেয়েগুলো কুঁকড়ে গিয়েছিল তারাই যেন চোখের সামনে দেখতে পেল হাজার সূর্য ওঠা।

পরের জন মানোয়ারা। সে এখন দারুণ ফুটবল খেলছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার বাড়ি। পাচার হয়ে ফিরে আসার পর, যে মেয়ে কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়েছিল, সে-ই এখন সারভাইভার লিডার। নিজেকে সামনে রেখে বলছে, ‘এ ভাবেও ফিরে আসা যায়।’ স্কুলে যাচ্ছে, আর ফুটবলে শট মেরে নাম কুড়োচ্ছে সব দিকে।

শ্রী আবার নিজে থেকেই সচেতনতার পাঠ পড়াচ্ছে। গত ২৪ জানুয়ারি, ‘জাতীয় শিশুকন্যা দিবস।’ সে দিন বছর ১৮-র মেয়েটা বিডিও অফিসে গিয়ে শিশু নিরাপত্তা নিয়ে তার বক্তব্য রাখে। ছিল স্কুলের বাচ্চারাও। যে নিজে প্রায় পাচার হয়ে গিয়েছিল, যার জীবনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সে-ই এখন আলোয় ফেরা মেয়েদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।

রিয়া-দিয়া — দু’জনেই এখন কলেজে পড়ে। ওরা দু’জনেই স্কুলে যাওয়ার পথে পাচার হয়ে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর নিজেদের ফিরে পেতে করতে হয়েছে অসম লড়াই। সেই লড়াইয়ে শরিক হয়েছিল ‘বন্ধনমুক্তি।’ বারবার কাউন্সেলিং করিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল মূলস্রোতে। এতে ক্যানিংয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিরাট ভূমিকা ছিল। সেই দুই মেয়ে এখন আলোয় ফেরা মেয়েদের কাছে যায়। স্কুলে-কলেজে গিয়ে পাচার নিয়ে সচেতন করে। বলে সেই গল্পটা। ওদের কথায়, ‘মা-সহ দু’টো বাচ্চাকে তুলে নিয়ে যায় পাচারকারী। মা ফিরে আসতে পারলেও বাচ্চাগুলো ওদের জিম্মায় থেকে গিয়েছিল। তাই ঝুঁকি একটা নিতেই হয়।’ এই দুই মেয়ে পুলিশের সাহায্যে ২ বছর ও ৪ বছরের দুই দুধের শিশুকে উদ্ধার করে। তাদের গায়ে তখন ছ্যাঁকার দাগ।

এর মধ্যে ফতিমা আবার ‘ইলফত’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পেয়েছে কলিঙ্গ স্কলারশিপও। বলল, ‘ইলফত হচ্ছে সারা ভারত থেকে আলোয় ফিরে আসা মেয়েদের একটা সংগঠন। আমাদের অধিকার নিয়ে আমরা নিজেরাই কাজ করব।’ অসম সাহসী আমিনা নিজের পাচারকারীকে ধরিয়ে দেয়। দেখা যায়, সে শুধু আমিনাকেই নয়, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা মিলিয়ে বহু মেয়েকে পাচার করেছিল। পুলিশের খাতায় এক নম্বরে নাম।

রয়েছে নিরুপমা। যে নাচের জন্য এক দিন তাকে পাচার হতে হয়েছিল, সেই এখন শিক্ষয়িত্রী। নাচের তালে ফুটিয়ে তুলছে জীবনবোধ। ‘বন্ধনমুক্তি’র অন্য সবাই মিলে ছোট ছোট নাটকের মাধ্যমে চালাচ্ছে কাউন্সেলিং, পাশাপাশি সচেতনতাও।

এখনও যারা আঁধারে আছে, চোখ খুলছে তারা। নিজেদের মতোই কাউকে পেয়ে শক্ত হাতে হাল ধরতে প্রস্তুত হচ্ছে ওরাও। ওদের কেউ হতে চায় পি ভি সিন্ধু, কেউ হতে চায় সমাজসেবী। কেউ বা পুলিশ হয়ে পাচার বন্ধ করতে চায়।

এই সঞ্জীবনীসুধার নামই বন্ধনমুক্তি —‘মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়…।’

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Women, #trafficking of women, #sex trafficking

আরো দেখুন