দেশ বিভাগে ফিরে যান

মোদী আমলে রেলের যাত্রী সুরক্ষা নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন বিরোধীরা

June 3, 2023 | 4 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: শুক্রবার সন্ধেয় বালেশ্বরের কাছে যশবন্তপুর হামসফর এক্সপ্রেসকে ধাক্কা মেরে মালগাড়ির উপর শালিমার-চেন্নাই করমণ্ডল এক্সপ্রেস উঠে যায়। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে ২৯৫ জনের। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্তত ৬৫০ জন। বহু দুর্ঘটনাগ্রস্তকে এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মৃতদের মধ্যে বাংলারও অনেকে রয়েছেন।

এখন কোটি টাকার প্রশ্ন কীভাবে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা হল এবং এতো মানুষকে প্রাণ হারাতে হল? এই দুর্ঘটনার দায় কার? কোন ভুলে প্রাণ গেল এত মানুষের? এখনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। রেল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। সামনে এসেছে দুর্ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ভুল ট্র্যাকে’ বা ‘লুপ লাইনে’ চলে গিয়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস!

ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে রাতভর অভিযান চালিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া তিনটি ট্রেনের বগির নিচে আটকে পড়া মানুষদের বের করে আনতে ওয়েল্ডিং গ্যাস কাটার ও ইলেকট্রিক কাটার ব্যবহার করা হচ্ছে। মালগাড়ির বগির উপর করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন। দেখলে মনে হবে, কেউ যেন ধরে বসিয়ে দিয়েছে! পাশেই বেশ কয়েকটি কামরা লাইনের দু’দিকে কোনওটা কাত হয়ে, কোনওটা উল্টে পড়ে আছে। ওড়িশার বাহানগা বাজার এলাকার যে ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, তা দেখলে মনে হবে মালগাড়ির তিন-চারটি বগিকে একেবারে পিষে দিয়ে শেষমেশ একটি বগির মাথায় উঠে থমকে গিয়েছে করমণ্ডলের ইঞ্জিন। মালগাড়িকে পিছন থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেস ধাক্কা মেরেছিল কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

যে ভাবে মালগাড়ির উপরে করমণ্ডলের ইঞ্জিন উঠে গিয়েছে, তা দেখলে সাদা চোখে মনে হবে, পিছন দিক থেকে সজোরে ধাক্কা মারার অভিঘাতের ফল। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, কত গতিতে ধাক্কা মারলে করমণ্ডলের ইঞ্জিন মালগাড়ির উপর উঠে যেতে পারে? রেল যদিও তাদের বিবৃতিতে মালগাড়ির প্রসঙ্গ আনেনি। করমণ্ডল এবং বেঙ্গালুরু সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের বেলাইন হওয়া এবং পাশাপাশি ধাক্কাকেই কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। দুর্ঘটনায় সময় কত গতিতে ছুটছিল ট্রেনটি সে বিষয় এখনও স্পষ্ট নয়। তবে করমণ্ডল যে ভাল গতিতেই ছুটছিল, ধাক্কার অভিঘাতে সেটাই প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর পরই করমণ্ডলের সামনের দিকের কয়েকটি কামরা একেবারে দুমড়েমুচড়ে যায়। মোট ১৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। তবে যে দৃশ্য বার বারই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, কী ভাবে মালগাড়ির উপরে চেপে বসল ইঞ্জিন? রেলের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতে, যে কোনও ইঞ্জিনের সামনে, বা কামরার মধ্যে ও পিছনে ‘বাফার’ থাকে।

রেলের তরফে একটি যৌথ পরিদর্শন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ওই যৌথ রিপোর্টে সিগন্যালের ত্রুটির কথাই বলছেন রেল আধিকারিকেরা। প্রাথমিক রিপোর্টে উঠে এল সিগন্যালের ত্রুটির বিষয়। যৌথ পরিদর্শন রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘আপ মেন লাইনে সবুজ সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ট্রেনটি সেই লাইনে ঢোকেইনি। ট্রেন ঢুকেছিল লুপ লাইনে। সেখানে আগে থেকে একটি মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তার সঙ্গে সংঘর্ষে করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়।’’

যদিও ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস ছিল না। তাই এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় বালেশ্বর কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের দেখতে যান মমতা। তারপর দেশের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোকে পাশে দাঁড় করিয়ে এই দুর্ঘটনা নিয়ে ফের একবার রেলের সমালোচনায় মুখর হলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।

এদিন মমতা বলেন, “মনে হয় রেলের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।’’ এখানেই থামেননি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, “কিছু তো একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। এতগুলো মানুষের জীবন চলে গেল। ভাল করে বড় তদন্ত করা প্রয়োজন।”

উল্লেখ্য, রেলের পরিকাঠামো নিয়ে মাসখানেক আগেই সরব হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ৩ মে হাওড়া থেকে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে চেপে মালদহে গিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। পরের দিন মালদহের সভা থেকে বলেছিলেন, “কালকে গুঁতুনি খেতে খেতে ট্রেনে এসেছি। গোঁত্তা খেতে খেতে এসেছি। কী অবস্থা হয়েছে রেলের। কালকে আমি রাম ধাক্কা খেয়েছি। আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা কী ধাক্কা খেয়েছেন আমি জানি না!” মমতা এও বলেছিলেন, তিনি রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে যা যা করে এসেছিলেন, যাত্রী নিরাপত্তার সেসব অনেক বন্দোবস্ত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত তুলে দিয়েছে। কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানায় ও দ্বিতীয় মনমোহন সিং সরকারের সময়ে রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা। ফলে রেল সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা রয়েছে।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব ওড়িশার বালাসোরে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য একটি উচ্চ-পর্যায়ের তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতে রেলের গাফিলতির জন্যই এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হল। এরপরই মোদী সরকারের নাম না করেই তিনি বলেন, “এরা আসলে রেলকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি আগে বহুবার করমন্ডল এক্সপ্রেসে যাতায়াত করেছি। এই ট্রেনটি ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ।

তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ টুইটারে লেখেন, ২৮৮ জন নিহত, ৮০০ জন আহত। তাহলে, বন্দে ভারত ও বুলেট ট্রেন কি যাত্রীদের নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কেন ভারতের মাত্র ২% রেললাইন সংঘর্ষ-বিরোধী কাভচ সিস্টেম দ্বারা আচ্ছাদিত (anti-collision Kavach systems), যার কাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ বছর আগে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন শুরু করেন?

যেভাবে করমণ্ডল, হাম সফর এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ির সংঘর্ষ হয়েছে তাতে রেলের পরিকাঠামো নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠে গেল। এও প্রশ্ন উঠছে, দুর্ঘটনা শূন্য রেল চলাচল করার ব্যাপারে এক বছর আগে যে কবচ সিস্টেম কার্যকর করা নিয়ে হইহই হয়েছিল সেই প্রযুক্তির কী হল? বিরোধীরা বলছেন, মোদী সরকার মুখে ‘উন্নত রেল পরিসেবা’র কথা বলে যাত্রীভাড়া বাড়ালেও যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ তা শুক্রবারের মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনা প্রমান করে দিল। অনেকে খোঁচা দিয়ে বলেছেন ‘বন্দে ভারত’ নিয়ে গালভরা কথা বললেও প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও দুর্ঘটনার খবর আসে। আসলে চমক দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রাথমিক বিষয়গুলিকেই গুরুত্ব দিতে ভুলে গেছেন। যেমন, রেলের যাত্রী সুরক্ষা!

মাত্র কদিন আগের ঘটনা। বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধান নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, চোদ্দ সালের আগে ভারতে রেল পরিকাঠামো বলে কিছু ছিল না। দ্রুত গতিতে ট্রেন চলবে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী এও জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রে তাঁর সরকার গঠনের পর চতুর্মুখী পরিকল্পনায় রেলের বাড় বৃদ্ধি হয়েছে। তার পর সাত দিনও কাটেনি। মালগাড়ির সঙ্গে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের মুখোমুখি ধাক্কায় প্রাণ গিয়েছে প্রায় তিনশ মানুষের। অতীতে দেখা গিয়েছে, এহেন রেল দুর্ঘটনার পর রেলমন্ত্রীরা দায় নিয়ে ইস্তফা দিয়েছেন। বিরোধী দল থেকে সমস্বরে সে সব দাবি এখনও ওঠেনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তৃতার ফুটেজ এখন তাঁকেই যেন তাড়া করে ফিরছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#opposition, #Modi Government, #train accident

আরো দেখুন