স্বামীকে হারিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের স্টিয়ারিংয়ে জীবনযুদ্ধ উষার
দিনের ব্যস্ত সময়ের শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে থিকথিকে ভিড়। তার উপর মৌলালিতে মিছিল চলায় ফ্লাইওভারে সারিবদ্ধ গাড়ি। তীব্র যানজটের ফাঁক গলে তিরের বেগে সাইরেন বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটি অ্যাম্বুল্যান্স। গন্তব্য বিআর সিং হাসপাতাল। এ পর্যন্ত মোটামুটি চেনা দৃশ্য। কিন্তু চালকের আসনের দৃশ্যটা একটু অন্য রকম। কারণ সেখানে বসে স্টিয়ারিং সামলাচ্ছেন এক মাঝবয়সি মহিলা। নাম উষা দেবী। অ্যাম্বুল্যান্সের স্টিয়ারিং হাতে শহর দাপিয়ে বেড়ান জীবনের বহু যুদ্ধ জয় করে আসা এই মহিলা। কলকাতা তো বটেই, গোটা দেশে মহিলা অ্যাম্বুল্যান্স চালক খুবই বিরল। সহকর্মীদের কাছে সমাদৃত উষার প্রশংসা বি আর সিং হাসপাতালের কর্তাদের মুখেও।
বিহারের সিওয়ানে উষার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাড়ির লোকজন বিয়ে ঠিক করেন। পাত্র নৈহাটিতে রেলের ক্লার্ক। বিয়ের পর প্রথম বিহার ছেড়ে বাংলায় আসা। তখন আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বামী-সন্তান-সংসারের স্বপ্ন উষার চোখে। কিন্তু সে স্বপ্ন ক্ষণিকের। তিনি যখন অন্তঃসত্ত্বা, তখন হঠাৎই জ্বরে ভুগে মারা যান স্বামী। গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে ঘোর চিন্তায় পড়েন উষা। সেই শুরু জীবন যুদ্ধের। দিশাহারা হয়ে প্রথমে ফিরে যান বিহারে। জন্ম দেন কন্যাসন্তানের। কিন্তু সে শিশু বিশেষ ভাবে সক্ষম। উষার কথায়, ‘তখনই ঠিক করি, ঘুরে দাঁড়াতে হবে। না হলে মেয়েকে বড় করে তুলতে পারব না।’
কিন্তু ক’জনের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই আর সহজ হয়? উষার যুদ্ধটাও সহজ ছিল না। শুরু করেন স্কুল স্তর থেকে। নতুন করে স্কুলে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন। এ পর্যন্ত সকলের সমর্থনও পেয়েছেন। সমস্যা হয় চাকরির খোঁজ শুরু করতেই। উষা বলেন, ‘তখন আমি পাগলের মতো যে কোনও একটা চাকরি খুঁজছি। কিন্তু সব কাজে সম্মতি ছিল না রাজপুত শ্বশুরবাড়ির। পরীক্ষা দিয়ে রেলের গ্রুপ-ডি পদে চাকরি পাই। সেখানে আপত্তি। তবে আমার বাপের বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন পেয়েছি। শেষমেশ রেলের স্বাস্থ্য বিভাগে অ্যাটেন্ড্যান্ট হিসেবে কলকাতার নারকেলডাঙায় যোগ দিই।’ ১৯৯৬ সালে চাকরি নিয়ে দ্বিতীয়বার কলকাতায় আসা উষার।
স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করার সূত্রেই ভালো লেগে যায় অ্যাম্বুল্যান্স চালকের পেশা। প্রথমত চ্যালেঞ্জিং, দ্বিতীয়ত গ্রুপ-ডি থেকে গ্রুপ-সি পদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ। এক সহকর্মীর কাছে উষার প্রশ্ন ছিল, ‘ছেলেরা অ্যাম্বুল্যান্স চালাতে পারলে মেয়েরা কেন পারবে না?’ ওই সহকর্মীর উৎসাহেই স্থানীয় মোটর ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হন। পরিচিতদের কাছ থেকে গাড়ি চেয়েচিন্তে হাত পাকান। এ বার অপেক্ষা চালক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের। উষা বলেন, ‘এই পেশার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ খুঁজে পাই। রাস্তায় হাজার মানুষ, শ’য়ে শ’য়ে গাড়ির ভিড় কাটিয়ে জরুরি ভিত্তিতে রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার মধ্যে একরকম স্বস্তি কাজ করে। শুরুর দিকে সকলে বলত, মেয়ে হয়ে এমন কাজ পারবি?