দেশ বিভাগে ফিরে যান

‘মোদী ম্যাজিক’ অস্ত? তাই পুরনো জোটসঙ্গীদের দুয়ারে হাজির হতে চাইছে BJP

June 13, 2023 | 4 min read

ছবি:প্রতীকী

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: নীতিশের মতো অনেকেই বিজেপির সঙ্গ ছেড়েছে, এনডিএতে বিজেপির খবরদারি অনেক শরিক দলই হজম করতে পারেনি। হরিয়ানায় সঙ্কটে বিজেপি জোট। এই পরিস্থিতিতে কর্ণাটকের ভোটের ফলাফল বিজেপির বোধোদয় ঘটিয়েছে! দাক্ষিণাত্যে বিপর্যয়ের পর খোদ সংঘ পরিবারে ‘মোদী ম্যাজিক’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বিজেপি এখন তার রাজনৈতিক চালচলনে পরিবর্তন আনার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি বিজেপি বিরোধীদলগুলি ধিরে ধিরে সঙ্গবদ্ধ হতে শুরু করেছে। যা আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে যথেষ্ট উদ্বেগে রেখেছে জেপি নাড্ডা, অমিত শাহদের। কংগ্রেসের মোকাবিলায় ১৯৯৮ সালে তারা জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা ‘এনডিএ’ গড়ে তুলেছিল। সম্ভাব্য বিপদের আঁচ করে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখন নতুনভাবে সেই জোট গড়ে তুলতে সচেষ্ট।


আনুষ্ঠানিকভাবে এনডিএ জোট গঠিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ১৫ মে। সেই নিরিখে এ বছর সেই জোটের রজতজয়ন্তী। ধীরে ধীরে ছোট-মাঝারি-বড় মিলিয়ে ২৮টি দল হয়ে উঠেছিল এনডিএর শরিক। ২০১৪ সালের ভোটে নরেন্দ্র মোদীর উদয়ের পর ক্রমেই জোটধর্ম ভুলে বিজেপিতে শুরু হয় ‘মোদী–বন্দনা’। ২০১৫ সালের মে মাস থেকে নিয়ম ও ঘটা করে শুরু হয় নরেন্দ্র মোদীর ‘সুশাসনের’ বর্ষপূর্তি। এবারও তার অন্যথা হয়নি। নবম বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপনের অঙ্গ হিসেবে বেছে নেওয়া হয় নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন। কিন্তু সেই আনন্দযজ্ঞের তাল কাটে কর্ণাটক। কালক্ষেপণ না করে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলের’ চেষ্টায় তারা আঁকড়ে ধরতে চাইছে পুরোনো সঙ্গীদের, কোনো না কোনো কারণে অবহেলিত মনে করায় যারা বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দলীয় মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে স্পষ্ট জানিয়েছেন, বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বিরূপ, এই ধারণা দূর করতে হবে। বোঝাতে হবে, আঞ্চলিক দলগুলোর মনোভাবের প্রতি বিজেপি সহানুভূতিশীল ও দায়বদ্ধ।


পুরোনো জোট বাঁচিয়ে তোলার পাশাপাশি নতুন সঙ্গীদের জড়ো করার তাগিদ প্রথম দেখা যায় বিরোধীরা যখন নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠান বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০টি দল ঘোষণাপত্রে সই করে বর্জনের কথা জানালেও আরও চারটি সমমনস্ক দল সেই সিদ্ধান্তের শরিক হয়। সংখ্যায় যাতে হারতে না হয়, সে জন্য বিজেপি তৎপর হয়ে ওঠে। এত দিন যাদের শরিক হিসেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে, তাদের একজোট করতে উদ্যোগী হয়। প্রধানত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট ছোট রাজ্যভিত্তিক দলের দৌলতে তারাও এই বার্তা পৌঁছে দেয়, ২৪টি বিরোধী দল অনুষ্ঠান বয়কট করলেও ২৫টি দল যোগ দিচ্ছে। গণতন্ত্র ও জোট রাজনীতিতে সংখ্যার তাৎপর্য ও অবদান প্রবল। বিজেপিও দেখাল, যত দল তাদের বিরুদ্ধে, তার চেয়ে বেশি দল তাদের পক্ষে।


কর্ণাটকে বিপর্যয় না ঘটলে এবং সরেজমিন তদন্তের পর হারের কারণগুলো স্পষ্ট না হলে এই বোধোদয় তাদের হতো না। পুরোনো সঙ্গীদের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টাও গতি পেত না।


বিজেপির সঙ্গীদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো শিবসেনা ও অকালি দল। নরেন্দ্র মোদীর ‘সাম্রাজ্য বিস্তার ও আধিপত্যবাদ’ তাদেরও কোণঠাসা করেছে। বিজেপির কাছে জমি হারানোর শঙ্কা শিবসেনাকে জোট ত্যাগে বাধ্য করায়। বিতর্কিত কৃষি আইন পায়ের তলার জমি ঝুরঝুরে করে দিচ্ছে—এমন উপলব্ধির পর অকালি দলও প্রথমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ও পরে জোট ত্যাগ করে। একে একে জোট ছেড়েছে অন্ধ্র প্রদেশের তেলুগু দেশম ও বিহারের জোটসঙ্গী জেডিইউ। ভোট রাজনীতিতে পাটিগণিতের সুফল ছাপিয়ে ‘মোদী ক্যারিশমার’ রসায়ন যত দিন প্রশ্নাতীতভাবে কাজ দিয়েছে, তত দিন সঙ্গীদের উপেক্ষা আমলে নেয়নি বিজেপি। কর্ণাটক বুঝিয়ে দিল কৌশল বদল না করলে ২০২৪ বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সেই আশঙ্কা বিজেপির নতুন তাগিদের কারণ।
তবে তার আগেও ছোটখাটো অথচ গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বিজেপি যে পায়নি তা নয়। গত মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের কসবা পেঠ ও ছিনচোয়াড় বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন হয়। কসবা পেঠ আসনটি বিজেপি হেরে যায় কংগ্রেসের কাছে। অথচ গত ২৮ বছর ওই আসন ছিল বিজেপির দখলে। হারের কারণ কংগ্রেস প্রার্থীকে শিবসেনা (উদ্ধব) ও এনসিপির দৃঢ় সমর্থন। ছিনচোয়াড় কেন্দ্র বিজেপি জেতে বিক্ষুব্ধ শিবসেনা প্রার্থী ১৫ শতাংশ ভোট টানায়। ত্রিপুরা, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ড বিধানসভার ফলও তাদের কাছে শিক্ষণীয়। ভোটের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বুঝতে পারে রাজ্য রাজনীতিতে ত্রিপুরার তিপ্রা মথা ও মেঘালয়ে কনরাড সাংমার দল এনপিপির শক্তি ও গুরুত্ব কতটা। নির্বাচনী প্রচারে দুই দলকে বিপুল গালমন্দ করেও (মেঘালয়ের সর্বনাশের কারণ হিসেবে অমিত শাহ তো সাংমা পরিবারকেই তুলাধোনা করেছিলেন) ফল বেরোনোর পর কালক্ষেপণ না করে দুই দলের সঙ্গে বিজেপি হাত মিলিয়ে সরকারের অংশীদারত্ব অর্জন করে। এনপিপি আসনসংখ্যা ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২৬ করে ফেলে। বিজেপিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় ২টি আসন জিতে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার তাড়নায় সাংমাদের ‘চোর পরিবার’ রাতারাতি সাধু হয়ে পড়ে। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বন্ধু পূর্ণ সাংমা বেঁচে থাকলে আজ গর্ববোধ করতেন।’ নাগাল্যান্ডে এনডিপিপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। এনডিপিপির আসন বাড়লেও বিজেপির আসন কিন্তু স্থিতিশীল।


উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ছোট দলগুলো ছাড়াও পুরোনো জোট নতুনভাবে গড়ে তোলার তাগিদে বিজেপি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তেলুগু দেশম ও অকালি দলের দিকে। ওডিশায় বিজেপির সঙ্গে তাদের ভোট–পরবর্তী সমঝোতার দরজা অনেক দিন ধরেই খোলা। তেলুগু দেশমের সঙ্গে জোট বাঁধলে ওই রাজ্যের শাসক দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস কী করবে, সেই প্রশ্ন অবশ্য তাদের ভাবাচ্ছে। বিজেপির নীতিনির্ধারকদের ধারণা, কেন্দ্রে বিজেপির প্রয়োজনে সঙ্গ দেওয়া ছাড়া ওই দলের নেতা জগনমোহন রেড্ডির অন্য উপায় নেই। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ বিজেপির হাতিয়ার। ওই অস্ত্রে উত্তর প্রদেশের মায়াবতী যেমন ঘায়েল হয়েছেন, জগনমোহনও তেমনই বশীভূত হবেন।


বিজেপির বড় জোটসঙ্গী বলতে টিকে রয়েছে একমাত্র তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে। শিব সৈনিকদের ওপর একনাথ শিন্ডের প্রভাব কতটা, তা এখনো পরীক্ষিত নয়। এই অবস্থায় কর্ণাটকের জেডিএসকে কাছে টানতে বিজেপি সচেষ্ট। দায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দেবেগৌড়ার তৈরি জেডিএসেরও। এবারের নির্বাচনে তাদের ধূলিসাৎ করেছে কংগ্রেস। টিকে থাকতে হলে বিজেপিই ভরসা। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন বর্জন না করার সিদ্ধান্ত দুই দলকে কাছাকাছি এনেছে। ওডিশার ট্রেন দুর্ঘটনার পর রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি সমর্থন না করার মধ্য দিয়েও জেডিএস নেতৃত্ব তাদের তাগিদ বুঝিয়েছে। প্রয়োজন যেখানে দুই পক্ষেরই, সেখানে জোটবদ্ধ হওয়া হয়তো সময়ের ব্যাপার।
শুধু দেখার, এনডিএকে নতুনভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিজেপি কতটা নমনীয় হয়। প্রথমে টিকিট বণ্টন ও পরে সরকার গঠনের সময় মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগিতে। ২০১৪ সালে লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপি লড়েছিল ৪২৭ আসনে। জিতেছিল ২৮২টি। জোটের মোট ২১টি দলের আসন ছিল লোকসভায়। ২০১৯ সালে ৪৩৭ আসনে দাঁড়িয়ে বিজেপি জিতেছিল ৩০৩টি। জোটসঙ্গীদের মধ্যে লোকসভায় উপস্থিতি ছিল মাত্র ১২টি দলের। মাৎস্যন্যায় নীতি মেনে চলা বিজেপি ক্রমেই একা হয়ে পড়েছিল। কর্ণাটকের ফল তাদের পুরোনো রাস্তায় কতটা ও কোন মূল্যে ফেরায়, আগামী দিনের দ্রষ্টব্য সেটাই।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Modi Magic, #allies, #bjp, #politics, #2024 loksabha elections

আরো দেখুন