বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

বাংলায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি – ‘ঘেঁটুপুজো’

June 15, 2023 | 3 min read

ঘেঁটুপুজো

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: “বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।” রূপসী বাংলার এমনই মুখ দেখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। ভাঁটফুল মানেই বেহুলার সতীত্বধর্মের প্রতীক বাংলার এক গুপ্ত ভাবজগৎ। যা আজও ফুটে চলেছে, বাংলার মাঠে ঘাটে, পথে-প্রান্তরে।

এই ভাঁটফুলের অপর নাম ঘেঁটুফুল। এই ফুল দিয়েই পুজো হয় ঘন্টাকর্ণ নামে বাংলার এক লৌকিক দেবতার। ফাল্গুন মাসে যে বরবধূর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে,অথবা আগামী বৈশাখে যে যুবক-যুবতীর বিবাহ পাকা হয়ে আছে, প্রাক-বিবাহ পর্বে তাদের যাবতীয় চর্মরোগ নির্মূল করার জন্য অত্যাবশ্যক এই ভেষজ ঘেঁটুফুল এবং তার পাতা। এই ফুলেই অবস্থান করেন ঘেঁটুঠাকুর।

ঘেঁটুফুল

বাংলার এক অবলুপ্তপ্রায় শিশু-সংস্কৃতি হচ্ছে ঘেঁটুপুজোর ছড়া।

‘ঘেঁটু যায়, ঘেঁটু যায় খোস পালায়’

‘যে দেবে মুঠো মুঠো
তার হবে হাত ঠুঁটো
যে দেবে কড়াই কড়াই
তার ঘরে সোনা ছড়াই।’

তিন-চার দশক আগে গ্রামবাংলার বালক-বালিকারা কলার দেল বা পাল্কি নিয়ে হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, বাঁশি সহযোগে হরিনাম সঙ্কীর্তনের মতো ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে বাড়ি বাড়ি ঘুরত। ঘেঁটুঠাকুরের গান/ ছড়া গেয়ে বেড়াত। কিছু জায়গায় কলার বাসনার পরিবর্তে লাঠিতে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। এভাবেই গৃহস্থ বাড়ি থেকে চাল ও পয়সা সংগ্রহ করে তাতে করা হত ফাল্গুন সংক্রান্তিতে ঘেঁটু ঠাকুরের বার্ষিক পুজো।

প্রচলিত পুজো পদ্ধতি অনুসারে দেখা যায় ঘেঁটুর কোনও নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। কোথাও কোথাও একটি ভুষোকালি মাখা মাটির হাঁড়িকে ঘেঁটুর প্রতীক হিসেবে পুজো করা হয়। পাশে সাজানো হয় গোবর, কড়ি, তেল-হলুদ মাখানো কাপড়ের টুকরো, টুকরো সিঁদুর এবং অবশ্যই ভাটফুল বা ঘেঁটুফুল। মেয়েরা সামনে বসে ছড়া কেটে চাল, গুড় ইত্যাদি অর্ঘ্য হিসেবে দেবতাকে নিবেদন করে। কোথাও আবার পুরোহিত দিয়ে শাস্ত্রীয় মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেও পুজো করা হয়। সবশেষে কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা বাঁশের লাঠি দিয়ে ভুষোকালি মাখানো হাঁড়িটিকে ভেঙে দেয়।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, যাঁরা ভুষোকালি মাখা হাঁড়িটিকে ভাঙে তাঁদের হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। হাঁড়ির ভুষো জোগাড় করে কাজলের মতো করে চোখে পরার রীতিও কোনও কোনও জায়গায় প্রচলিত রয়েছে। লোকবিশ্বাস, এতে নাকি চর্মরোগের সঙ্গে সঙ্গে চক্ষুরোগের আশঙ্কা কমে। অনেক সময় গোবর ডেলা পাকিয়ে মুখের‌ আদলে তৈরি করে ঘুঁটে দেওয়ার মতো করে রাখা হয় বাড়ির সদর দরজার পাশে। এই মুখের আদলে কড়ি আর সিঁদুর দিয়ে নাক ও চোখ তৈরি করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এই মূর্তি বাড়ির দেওয়ালে রাখলে রোগ-জীবাণু এবং অশুভ শক্তি গৃহে প্রবেশ করতে পারবে না।

ঘেঁট দেবতার পুজোর প্রচলন কীভাবে হল? তা জানতে পুজোর পাঁচালির কাহিনির উপরেই নির্ভর করতে হয়। তবে কথিত আছে, ঘেঁটু হলেন এক জন অভিশপ্ত দেবতা। তিনি কোনও একটি কুকর্মের জন্য ভগবান বিষ্ণুর রোষানলে পড়েন। দেবলোক থেকে নির্বাসিত হয়ে পিশাচকুলে জন্মগ্রহণ করেন। আজীবন এই অভিশাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর জন্য তিনি ঘোরতর বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। এমনকি, বিষ্ণুর নাম পর্যন্ত যাতে শুনতে না হয়, সে জন্য তিনি কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন। সেই থেকেই ঘেঁটুর অপর নাম হয় ‘ঘণ্টাকর্ণ’।

অনেকে আবার মনে করেন, সূর্যের লৌকিক সংস্করণ হলেন ঘেঁটু। সূর্যের আলোয় চর্মরোগ সারে এই বিশ্বাস থেকেই মানুষের মনে হয়েছিল সূর্যকে তুষ্ট করতে পারলেই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সেই ধারনা থেকেই ঘেঁটু পুজোর উদ্ভব উদ্ভব বলে মনে করা হয়। কিছু জায়গায় তাই, ঘেঁটুকে ‘চর্মরোগের দেবতা’ বলে অভিহিত করা হয়।

ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, দুই ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলায় ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ পুজোর রীতি প্রচলিত রয়েছে। ঘেঁটু সংক্রান্তি প্রতি বছরই আসলেও বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার এই সংস্কৃতি।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Ghetu pujo, #West Bengal

আরো দেখুন