বহুত্ববাদ না-পসন্দ, তাই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে অতি উৎসাহী বিজেপি?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বিজেপির ঘোষিত লক্ষ্য—‘এক দেশ, এক বিধান (সংবিধান), এক নিশান (পতাকা)’। এই লক্ষ্য তাদের পূরণ হয়েছে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে। ওই অনুচ্ছেদ জম্মু-কাশ্মীরকে আলাদা পতাকা ও সংবিধান দিয়েছিল। এখন বিজেপির লক্ষ্য—‘এক রাষ্ট্র, এক আইন’ প্রতিষ্ঠা। অঘোষিত লক্ষ্য—‘এক রাষ্ট্র, এক দল, এক নেতা’ গঠন। সে জন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই। বিজেপিবিরোধী দলগুলি মনে করছে, শাসক দল তাদের ঘোষিত ও অঘোষিত লক্ষ্য হাসিলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে হাতিয়ার করে আগামী লোকসভা ভোটের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের পথ প্রশস্ত করতে চাইছে। সে কারণে আইন কমিশন মাত্র ৩০ দিনের সময় দিয়েছে সবাইকে মতামত জানাতে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হচ্ছে দেশের সব নাগরিকের জন্য একটিই দেওয়ানি আইন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষের রীতিনীতি অনুযায়ী আলাদা বিধি চালু আছে। বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, সম্পত্তির অধিকার-সহ কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী হয়ে থাকে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে সব ধর্ম, জাত ও সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য একটাই নিয়ম হবে।
দেশের সবার জন্য ফৌজদারি আইন এক ও অভিন্ন, কিন্তু দেওয়ানি বিধি নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (RSS) ও তাদের ভাবাদর্শে তৈরি রাজনৈতিক দল বিজেপি (পূর্বতন জনসংঘ) সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলনে উৎসাহী। তাদের প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রতিশ্রুতির কথা বলা আছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্র সরকার গড়ার পর সেই প্রতিশ্রুতি পালনে উদ্যোগী হন। ২০১৬ সালের জুনে সরকার সে কারণেই তৎকালীন আইন কমিশনকে সবার সঙ্গে আলোচনার অনুরোধ জানিয়েছিল।
সরকারের সেই অভিপ্রায় অনুযায়ী ২১তম আইন কমিশন উদ্যোগীও হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের সঙ্গে আলোচনার পর ২০১৮ সালে তৎকালীন আইন কমিশন সরকারকে এক ‘কনসালটেশন পেপার’ জমা দেয়। এতে কমিশন জানায়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। এ মুহূর্তে তার দরকারও নেই।
এখন ফের সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন করা নিয়ে আইন কমিশন নতুনভাবে উদ্যোগী হয়েছে। এ বিষয়ে তারা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের মতামত জানতে চেয়েছে। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সেই মতামত আইন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে।
পাঁচ বছর পর ২২তম আইন কমিশন নতুন করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে মতামত সংগ্রহে উদ্যোগী হওয়ার কারণ বিজেপির রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও তাড়না বলে মনে করা হচ্ছে। বিজেপির ঘোষিত তিন লক্ষ্যের দুটি ইতিমধ্যেই পূরণ হয়েছে। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির হচ্ছে। জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে শুধু অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রণয়ন। এই তিনটি প্রতিশ্রুতি বিজেপিকে অন্য সব রাজনৈতিক দল থেকে আলাদা করেছে। নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি চায় আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে দ্রুত এই শেষ প্রতিশ্রুতিও পালন করে ফেলতে।
কেন্দ্রীয় সরকার ২২তম আইন কমিশন গঠন করেছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২০২২ সালের নভেম্বরে কমিশনের চেয়ারম্যান হন কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ঋতুরাজ অবস্থি। তাঁর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চই হিজাব মামলার রায় দিয়েছিলেন। কর্ণাটকের স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধ করা নিয়ে রাজ্য সরকারের নির্দেশকে মান্যতা দিয়েছিলেন। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সম্প্রতি তিনি দেশদ্রোহ আইন বলবৎ রাখার পক্ষেও মত দিয়েছেন।
কমিশনের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন কেরালা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি কে টি শঙ্করণ, যিনি ‘লাভ জিহাদ’-সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অন্য সদস্য আইনের অধ্যাপক আনন্দ পালিওয়াল। তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের অনুগামী।
অন্যদিকে বিজেপির বক্তব্য, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর হলে সামাজিক সৌহার্দ্য বজায় থাকবে। লিঙ্গবৈষম্য দূর হবে। মহিলারা শক্তিশালী হবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এর ফলে সংবিধানের মূল ভাবধারা বজায় থাকবে। ‘একটি রাষ্ট্রে দুই প্রধান, দুই নিশান ও দুই বিধান থাকতে পারে না।’ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এই বাক্যবন্ধ বিজেপির নীতি নির্ধারণে স্পষ্ট।