লোকবিশ্বাস ও বাস্তবের মিশেল ‘যোগাদ্যা’র পুজো, জেনে নিন এই সতীপীঠের মাহাত্ম্য
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: সতীর একান্নপীঠের মধ্যে অন্যতম পিঠ রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলায় কাটোয়া মহকুমার ক্ষীরগ্রামে। এখানে পূজিতা হন দেবী যোগাদ্যা। গ্রামের সুখ-দুখের বারোমাস্যা মিশে যায় যোগাদ্যায়। কথিত আছে, সতীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল ক্ষীরগ্রামে। ক্ষীরগ্রামে ঢোকার মুখেই ক্ষীরদিঘি নামে বড় এক জলাশয় রয়েছে। ক্ষীরদিঘির জলের ওপরেই অবস্থিত দেবীর মন্দির। গর্ভগৃহের অনেকাংশই জলে নিমজ্জিত থাকে। জলাশয়ের জলের মধ্যেই সারাবছর ডুবিয়ে রাখা হয় দেবীর সেই প্রাচীন শিলামূর্তিটি। দিঘির জল কখনও শুকায় না। ফলে দেবীর শিলামূর্তির দর্শনের সুযোগ সারাবছর পান না সাধারন মানুষ। নিয়ম রয়েছে শুধুমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তির আগের দিন এবং জ্যৈষ্ঠের চার তারিখে এই দেবীর দর্শন পায় ভক্তেরা।
কবে থেকে রাঢ় বঙ্গে যোগাদ্যা যে দেবীর পুজো শুরু হয় তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে।
‘ক্ষীরপীঠে মহামায়ে করিয়া স্থাপন।
রাবণ বধিতে লঙ্কা গেলা নারায়ণ।।’
কৃত্তিবাসী রামায়ণে যা ক্ষীরপীঠ, তাই অধুনা ক্ষীরগ্রাম। লোকবিশ্বাসে মা যোগাদ্যা দেবী মহামায়ারই অন্য রূপ। মার্কণ্ডেয় পুরাণেও এই দেবীর বর্ণনা আছে।
অবধূতা রামায়ণ অনুসারে মহাকালী বা ভদ্রকালী অর্থাৎ দেবী মহামায়ার সেবক মহীরাবণ রাম ও লক্ষ্মণকে হত্যা করার পরিকল্পনায় ছলনার বশে পাতালে নিয়ে আসে। মহাকালীর সামনে বলিদান দেওয়ার সময় মহীরাবণকেই বধ করে লক্ষ্মণ। পরে দেবী মহামায়া সহ সেবক হনুমান রাম ও লক্ষ্মণকে উদ্ধার করে ৩দিন ধরে লাগাতার পাতালপথে এই ক্ষীরগ্রামে আসেন। এই হল দেবীর পৌরাণিক ইতিহাস।
অন্নদামঙ্গলে আছে,
‘ক্ষীরগ্রামে ডানিপাড় অঙ্গুষ্ঠ বৈভবঃ।
যোগাদ্যা দেবতা ক্ষীরকণ্ঠকঃ ভৈরবঃ।।’
দেবীর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলই গ্রামকে দিয়েছে সতীপীঠের মর্যাদা। ক্ষীরগ্রামের অদূরে আছে এক টিলার উপরে দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির। তাই এই গ্রামের নাম ক্ষীরগ্রাম।
ক্ষীরদিঘী লাগোয়া দেবীর মন্দির। মন্দিরে দেবীর কোন বিগ্রহ নেই। কারণ দেবীর বাস তো দিঘির জলে। গর্ভগৃহের দেওয়াল ঘেঁষে বেদী। সেই বেদীতেই দেবীর নিত্যপুজো।
শোনা যায়, সিংহপৃষ্ঠে আসীন কালো কষ্টিপাথরের দশভুজা মহিষমর্দিনী শক্তির দেবী যোগাদ্যার আসল মূর্তিটি হারিয়ে গেছিল অনেক আগেই। এরপরে, বর্ধমানের রাজা কীর্তি চন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে প্রায় ৮ বিঘা জমির উপর গ্রামের মূলভাগ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় যোগাদ্যার মন্দির নির্মাণ করান। যার তোরণদ্বারের স্থাপত্য নজরকাড়া। সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি তৈরি করেন দাঁইহাটের প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর। নতুন মূর্তিটি বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদিঘির জলেই। কেবল ৩১ বৈশাখ তা জল থেকে তুলে আনা হত সর্বসমক্ষে।
একই দেবীর জোড়া মূর্তি নিয়ে জোড়া মন্দির নিয়ে প্রচলিত রয়েছে একটি অলৌকিক ঘটনা। শোনা যায়, ক্ষীরদিঘি সংস্কারকালে নতুন মূর্তির সঙ্গে উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো যোগাদ্যা মূর্তি। মূর্তি ফিরে পাওয়ার আনন্দে গ্রামিবাসীরা গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির। সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন মন্দিরে। সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।
দেবী যোগাদ্যাকে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য লৌকিক ইতিহাস। শোনা যায়, মাঝরাতে দেবীর গর্ভগৃহের বন্ধ দরজার সামনে ঢাক বাজানো হয়। ঢাকের সেই বোল শুনে দেবী যোগাদ্যা ‘নৃত্য’ করেন। তবে সে সময় দেবীর ওই নাচের দৃশ্য কেউ দেখতে পান না। শুধুমাত্র ঢাকিই পায়ের নূপুরের শব্দ শুনে তা বুঝতে পারেন।
পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগাদ্যার মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে একমাস ধরে পালন করা হয় এই বিশেষ আচার। যে আচার ‘নিশি ঢম্বুল’ বলে পরিচিত। পৌষের সংক্রান্তির দিন থেকে মাঘ মাসের সংক্রান্তির পর্যন্ত পালন করা হয় ‘নিশি ঢম্বুল’। তবে নিয়ম রয়েছে এই ‘নিশি ঢম্বুল’ পালনে শুধুমাত্র এক ঢাকিই শুধু থাকতে পারবেন। দেবীর মন্দিরের কাছে তখন আর কেউ ঘেঁষতে পারবেন না।
যোগাদ্যা আদতে কৃষিদেবী। চৈত্র সংক্রান্তির দিন যোগ্যাদ্যার যে উৎসব হয়, তা এক মাস ধরে নানান রীতি, আচারের মধ্যে দিয়ে চলে । উল্লেখ্য হল লগ্ন উৎসব, জলমগ্ন, ক্ষীর কলস সিঞ্চন, ময়ূর নাচ, মৌর নাচ, বীরদর্পে মাটি কাঁপানো উৎসব, মালাকারের বিয়ে, উলগ পুজো, ডোম-চুয়ারি খেলা শেষে মহাপুজো। শোনা যায়, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও এই পুজোয় নরবলি হত। কথিত আছে দেবী যোগাদ্যা নিজেই নরবলির বন্ধের আদেশ দেন। এলাকার বত্রিশটি জাতি মিলিত প্রয়াসে চলে আসছে দেবী যোগ্যাদ্যা পুজো।