রাঢ় বাংলার অন্যতম শৈব তীর্থ – জামালপুরের বুড়োরাজ মন্দির
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা জামালপুরের বাবা বুড়োরাজ। এটি রাঢ় বাংলার অন্যতম প্রধান শৈব তীর্থও। বুদ্ধপুর্ণিমাতে বর্ধমানের সবুজে ঘেরা ছোট গ্রাম জামালপুরে বসে রাঢ় বাংলার বৃহত্তম বুড়োরাজ মেলা। বাবা বুড়োরাজের মন্দিরে একমাসের মূল সন্ন্যাসী ছাড়াও সাতদিনের ও পাঁচ দিনের সন্ন্যাসী হয়ে বিশেষ কৃচ্ছসাধন করেন সন্ন্যাসীরা৷ গঙ্গায় স্নান করে দূরদূরান্ত থেকে সন্ন্যাসীরা রোজ পুজো দেন৷ পূর্ণিমার পরেরদিন উত্তরীয় খোলা ও বান ফোঁটানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় সন্ন্যাস পর্ব৷
অনাদ্যের পুঁথিতে “বুড়োরাজ”কে বলা হয়েছে ,“তুমি চন্দ্র ,তুমি সূর্য্য ,তুমি দিবাকর ৷/ তুমি হর , তুমি হরি , তুমি বৃহস্পতি “৷ বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় দেবতা বাবা বুড়োরাজ শিব ও ধর্মরাজ উভয়েই শূন্য নিরঞ্জন এখানে একই মন্ত্রে পূজিত হন ৷
“নিরঞ্জনং নিরাকারং মহাদেব মহেশ্বরম্ ৷
শরনং পাপখন্ডনং ধর্মরাজ নমোহস্তুতে ৷৷”
জানা গেছে, বুড়ো শিবের “বুড়ো ” আর ধর্মরাজের “রাজ” এক সাথে মিলে গিয়ে নাম হয়েছে “বুড়োরাজ”৷ বাঙালি লোকসংস্কৃতি গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, এখানে দুই দেবতা মিলে সর্বজনপূজ্য লোকদেবতায় পরিণত হয়েছেন৷ সাধারণত মহাদেব বা শিবের কাছে পশু বলিদান হয় না ৷ কিন্তু, লৌকিক দেবতা বাবা বুড়োরাজের মন্দিরে পশু বলি দেওয়ার রীতির প্রচলন আছে ৷ এখানে বলির খাঁড়া( খড়্গ)-র মতো ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের রীতি প্রচলন আছে। কেউ এই সব অস্ত্র দিয়ে দেবতার উদ্দেশে বলি দিতে আসেন তো কেউ বা আবার দলবদ্ধ হয়ে অস্ত্র প্রদর্শন করে বীরত্ব দেখাতে। আজও বুদ্ধপূর্ণিমায় এখানে অসংখ্য পাঁঠা ও ভেড়া বলি হয়। মাঝে মধ্যেই বলির পাঁঠার ভাগ নিয়ে কিংবা কে আগে বলি দেবে তা নিয়ে মারামারিও বেধে যায় অস্ত্রধারীদের মধ্যে। হঠাৎই যেন ভেসে ওঠে আদিম সমাজের ছবি। মন্দিরের এক সেবায়েৎ বলছিলেন, যম-ধর্মরাজের উদ্দেশ্যেই এই বলিদান। বিপদ বা গভীর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ দেবতার কাছে কিছু মানত করে। বিপন্মুক্ত হলে তারা দেবতার উদ্দেশে পশুবলি দেয়। কেউ অন্য কিছু দান করে। যদিও সময়ের সঙ্গে পশুবলি আগের তুলনায় কমেছে।
এই মন্দিরটি চাঁদনি আকৃতির একটি খড়ের চালাঘর। মেঝেটি মাটির৷ পাকা মন্দির করার চেষ্টা হলেও তা ব্যর্থ হয় ৷ প্রতিবারই দেখা যায় মাথা ফাঁকা হয়ে যায় ৷ বাংলার অন্যান্য জায়গার ধর্মরাজের বিগ্রহ কূর্মাকৃতি হলেও জামালপুরে বুড়োরাজের বিগ্রহ কিন্তু দু’টি গৌরীপট্ট যুক্ত একটি মূর্তি। তার এক দিকে শিবলিঙ্গ অপর দিকে একটি গর্ত। মাটির কিছুটা নীচে থাকায় এর চেয়ে বেশি বোঝা যায় না।
মন্দিরের এক সেবায়েৎ-এর কথা থেকে জানা যায়, আনুমানিক ছ’শো বছর আগে এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গলে ছিল একটি উইয়ের ঢিপি। শোনা যায়, প্রতি দিন একটি গাই সেই উইয়ের ঢিপির উপর এসে দাঁড়াত। আর আপনা থেকেই উইয়ের ঢিপির উপরে দুধ পড়ত। সেই গরুর মালিক যদু ঘোষ এক দিন তার পিছু নিয়ে এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে আবাক হয়েছিলেন। সেই রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, ওখানেই দেবতার অধিষ্ঠান। পর দিন সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে শিবলিঙ্গ-গৌরীপট্ট সমেত পাথরের অদ্ভুত এক বিগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু, হাজার চেষ্টা করেও সেই বিগ্রহের শেষ পাওয়া যায়নি বলে সেটি সরানো সম্ভব হয়নি।
প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, সে দিন রাতে যদু ঘোষ ফের এবং ওই গ্রামের এক ব্রাহ্মণ মধুসূদন চট্টোপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পান যে, সেই বিগ্রহটিকে ওই স্থান থেকে সরানো অসম্ভব। তাই সেখানেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করতে চান। কিন্তু, গরিব সেই ব্রাহ্মণের পক্ষে নিত্যপুজোর ব্যয়ভার গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। তখন আবারও তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে প্রতি দিন তিন সের চাল আর দুধ দিয়ে পুজো করলেই হবে। সেই থেকে প্রতি দিন একটি থালায় তিন সের চালের নৈবেদ্য দিয়ে পুজো হয়। আর মাঝখানে একটা দাগ দেওয়া হয়। একাংশ শিবের উদ্দেশ্যে আর এক অংশ যম-ধর্মরাজের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। তবে, বিশেষ তিথিতে পরমান্ন ভোগ হয়। জামালপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বিগ্রহটি বৌদ্ধ যুগের। মূলত অনার্য এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনেই নাকি বাংলায় ধর্মপুজোর প্রচলন ঘটেছিল।
বুদ্ধপূর্ণিমায় প্রতি বছর এখানে বসে মেলা। মেলা চলে মাসখানেক। আজও মানুষের বিশ্বাস বুড়োরাজের দরবারে এসে বোবার মুখে কথা ফোটে, দৃষ্টিহীন দৃষ্টি ফিরে পায়, দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হয় কিংবা নিঃসন্তান সন্তানসম্ভবা হয়। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ এই সময় সন্ন্যাস পালন করেন। বৈশাখের দাবদাহ উপেক্ষা করে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ মিলিত হন এই দিনটিতে।