প্রাচীন কাল থেকেই রাঢ় বঙ্গে চলে আসছে বাশুলী দেবীর পুজো
মা বাশুলী বহুযুগ ধরে রাঢ়ভূমিতে বাঙালির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। প্রাচীন কালে সর্বময়ী জগজ্জননী প্রকৃতিমাতৃকা হিসেবে তিনি উপাস্য ছিলেন।

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: মা বাশুলী বহুযুগ ধরে রাঢ়ভূমিতে বাঙালির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। প্রাচীন কালে সর্বময়ী জগজ্জননী প্রকৃতিমাতৃকা হিসেবে তিনি উপাস্য ছিলেন। শোনা যায়, ১৪-১৫ শতকে বাঁকুড়ার ছাতনায় (ছত্তিনা বা ছত্তিনানগর) সামন্তভূম নামে একটি রাজ্যের রাজধানী। সামন্তভূমের এক রাজা উত্তর হামিরাকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন মা বাশুলী। এই দেবী বাশুলীর আদেশ পেয়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাথর নিয়ে আসেন রাজা। এই পাথর দিয়েই বাশুলী দেবীর মূর্তি তৈরি করা হয়। গোটা রাঢ়ভূমির জনপ্রিয় দেবী হিসেবে বাশুলী মায়ের পুজোর প্রচলন আছে। ছাতনায় দুটো বাশুলী মন্দির আছে।
বাশুলী দেবী এখানে দ্বিভুজা। ডান হাতে খড়্গ এবং বাঁ হাতে খর্পর ধারণ করেন। মায়ের মুখে প্রশান্ত হাসি, মা মুণ্ডমালিনী। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, মা এখানে দুই পায়ে দুটি পুরুষমূর্তিকে দলন করেন, মায়ের একটি পা একদিকের শায়িত পুরুষমূর্তির জঙ্ঘায় অপর পা অপর পুরুষমূর্তির মস্তকে স্থাপিত।
মেদিনীপুর জেলায় বরদাপল্লী অঞ্চলে চতুর্ভুজা মা বাশুলী পূজিত হন পঞ্চমুণ্ডি আসনে। মা এখানে পীতবর্ণা। মায়ের দক্ষিণে গণেশ, বামে কার্তিক, সম্মুখে জয়া বিজয়া, এবং মায়ের পেছনে যোগিনী। মা ঈষৎ দন্তবিস্ফার করে আছেন। আবার সমগ্র হুগলি জেলা জুড়ে বাশুলী মায়ের নানা পীঠস্থান দেখা যায়।
কথিত আছে, উত্তর হামিরাকে দেবী স্বপ্নে নিজের পুজো করার জন্য দেবীদাসের কথাও জানিয়েছিলেন। সেই আদেশ মেনে রাজা দেবীদাস এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস কে রাজবাড়ীতে আনা হয়। দেবীদাস পুজো করতেন এবং চণ্ডীদাস তাঁকে সাহায্য করতেন। বাশুলী মায়ের পুজোতে যে মাছ দেওয়া হয় সেই মাছ ধরার কাজও নাকি করতেন চণ্ডীদাস।
প্রাচীন দেবী মন্দিরের আশেপাশে প্রবাদ প্রচলিত আছে দেবী বাশুলী মানবী ছিলেন। বৈষ্ণব গ্রন্থ থেকে জানা যায়, চৈতন্যযুগ শুরু হওয়ার পূর্বে নবদ্বীপের অধিবাসীগণ বাশুলী মায়ের আরাধনা করত। কবি মুকুন্দ মিশ্র “বাশুলীমঙ্গল” কাব্য লিখেছেন ১৫০৭ (অথবা ১৫৭৭) খ্রিষ্টাব্দে। বাশুলী বা বিশাললোচনা মায়ের বর্ণনা মঙ্গলকাব্যে পাওয়া যায়।
“চামুণ্ডা নৃমুণ্ডমালা ধৃত রুধিরাম্বরা
সরক্ত কর্পর কাতি হাথে
শোণিত সিন্ধুর জলে কল্পবৃক্ষের মূলে
নরপ্রেতাসনে ভগবতী।”
মায়ের স্তুতি অন্যত্র এভাবে করেছেন বাশুলীমঙ্গলের কবি।
রণমুখী রুচি দুর্গা রুধিরাকাঙ্ক্ষিণী।
শরদিন্দুমুখী জয়া চকোরনয়নী।।
হরের ডমরু মাঝা মৃগত্রিলোকিনী।
আতঙ্করহিতমনা কঙ্কালমালিনী।।
তন্ত্রসার গ্রন্থে মা বাশুলী তাঁর ধ্যানমন্ত্রে এভাবে বর্ণিত মা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, দ্বিভুজা, উগ্ররূপা, খড়্গ ও খেটকহস্তা, রক্তবসনা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। জটামুকুটশোভিত মা শবের ওপরে অবস্থান করেন।
এছাড়াও ধর্মপূজাবিধানে মা বাশুলীর বন্দনার নির্দেশ আছে
বিশালবদনা দেবী বিশালনয়নোজ্জ্বলে।
দৈত্যমাংসস্পৃহে দেবী বিশালাক্ষী নমোহস্তুতে।।
চণ্ডীদাসের লেখায় উল্লেখ আছে,—
“শালতোড়া গ্রামে অতি পীঠস্থান
নিত্যের আলয় যথা।
ডাকিনী বাশুলী নিত্যা সহচরী,
বসতি করয়ে তথা।”
বাঁকুড়া জেলায় এই শালতোড়া গ্রাম। বৌদ্ধ সাহিত্য “পদ সমুদ্র” থেকে আরও জানা যায়, এই শালতোড়া গ্রামে সহজিয়া ধর্মপ্রচারিকা ডাকিনীদের আখড়া ছিল। রমেশচন্দ্র বসুর “বৌদ্ধ ও শৈব ডাকিনী ও যোগিনীদের কথা “( বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩৩৩/১ প্রকাশিত ) প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, যেসব ডাকিনী যোগিনীরা রক্তমাংসের মানুষ এবং বৌদ্ধ সহজযান ও বজ্রযান সম্প্রদায়ভুক্ত ধর্মচারিণী নারী ছিলেন। নানা সময় এদের নির্দেশেই অনেক তন্ত্রের গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। এভাবেই চণ্ডীদাস-বঁধুয়া বাশুলী মানবী থেকে আজ লৌকিক দেবী হিসেবে পূজিতা হচ্ছেন রাঢ় বাংলায়।
আবার কারও কারও মতে, দেবী বাশুলী হলেন সরস্বতীর একটি রূপ। তাঁর এক হাতে বীণা এবং অন্য হাতে রয়েছে বই। বাশুলী মন্দিরের পাশের ১৪ টি শিবমন্দির হলো দেউল রীতির এবং এগুলির গায়ে সূক্ষ্ম টেরাকোটার অলংকরণ রয়েছে। গয়ার এক মন্দিরে সরস্বতীর চতুর্ভুজ মূর্তি বাসিরী নামে পরিচিত।
রাঢ় বঙ্গের বাশুলী মন্দিরের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ, দেবীর মাহাত্ম্য আজও লোক মুখে বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে।